কেউ একজন নতুন ধারার কবিতা লিখলেই একটি কবিতার আন্দোলন গড়ে ওঠে না। ত্রিশের দশকে যদি বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশ একাত্ম না হতেন, তাহলে আধুনিক বাংলা কবিতার ত্রিশীয় ধারাটি গড়ে উঠত না। পোস্ট-মডার্নের প্যারাল্যাল আমেরিকাতে একটি কাব্যান্দোলন গড়ে ওঠে আশির দশকের গোড়ার দিকে, যেটি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই ধারাটিকে যারা আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তারা হলেন—রে আর্মান্ট্রাউট, বার্নাদেত মেয়ার, লেসলি স্কালাপিনো, স্টিফেন রডেফার, ব্রুস অ্যান্ড্রুজ, টম ম্যান্ডেল, অ্যালেন ডেভিস, জেমস শেরি, সুজান হাউই, কার্লা হ্যারিম্যান প্রমুখ। তাদেরকে আমেরিকানরা ডাকেন ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট হিসেবে। এদের মধ্য থেকে আমি একজনকে নিবিড়ভাবে পাঠ করার জন্য বেছে নিয়েছি, তিনি রে আর্মান্ট্রাউট। আমি তার কবিতা পড়েছি, অনুবাদ করেছি, তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং বাংলাদেশের কাগজে তাকে নিয়ে লিখেছি। নিউইয়র্ক রিভিউতে তার একটি কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুরু হয়। একপর্যায়ে ঠিক করলাম, তার নির্বাচিত গোটা পঞ্চাশেক কবিতা বাংলায় অনুবাদ করি। তাহলে এই অনুবাদ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রির ভেতরে ঢোকা যাবে। শব্দেরা কথা বলে শব্দের অধিক, শব্দেরা প্রতীকী, প্রতিনিধিত্ব করে এক-একটি গল্পের, চিত্রকল্পের, সংক্ষেপে এই-ই ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রি। এজরা পাউন্ড চিত্রকল্পকেই কবিতা করে তুলেছিলেন। ছোট ছোট পঙক্তি দিয়ে ক্ষুদ্র কলেবরের কবিতায় তুলে ধরতেন এক একটি অভিনব চিত্রকল্প। সেইসব চিত্রকল্প কখনও কখনও চেতন-অবচেতনের মাঝখানে সচেতনতার ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিত। তারই আরেক ধাপ উত্তরণ ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রি। কখনও পারম্পর্যহীন পঙক্তিগুচ্ছের সন্নিবেশ, কখনও এক কবিতায় অনেক কণ্ঠস্বর, কখনও এক-একটি শব্দই প্রতিনিধিত্ব করছে এক একটি গল্প-কিংবদন্তি। মাঝে-মধ্যে পুরো কবিতাটিই অর্থহীন হয়ে ওঠে, কিন্তু বোধের গভীরে কোথায় যেন আলতো করে একটি খোঁচা দিয়ে যায়। রে আর্মান্ট্রাউটের ৫০টি কবিতা অনুবাদ করতে করতে এসব মনে হয়েছে আমার। যারা পরিশ্রমী পাঠক, খনি-শ্রমিকের মতো দুটি পঙক্তির মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা, সেটি খনন করে তুলে আনতে চান লুক্কায়িত স্বর্ণ, এই কবিতা তাদের জন্য। আমাকে একজন মার্কিন কবিতা-পণ্ডিত বলেছিলেন, কবিতার অনুবাদ হয় না। মূল ভাষার কবিতা পড়ে নতুন ভাষায় একটি নতুন কবিতা লিখতে হয়। অর্থাৎ ট্রান্সলেশন নয়, করতে হয় ট্রান্সক্রিয়েশন। আর সেই কাজ কেবল একজন কবিই করতে পারেন। অন্য কারও পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। রে আর্মান্ট্রাউটের কবিতাগুলো অনুবাদ করতে গিয়ে আমি এই উপদেশ মনে রেখেছি। তার পরেও চেষ্টা করেছি মূল কবিতার যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকতে। আশা করি, বাংলা ভাষার কবিদের কাছে এবং কবিতাপ্রেমী পাঠকদের কাছে এই গ্রন্থটি গুরুত্ব পাবে। কাজী জহিরুল ইসলাম জানুয়ারি, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ