নারী সভ্যতার সুতিকাগার, পৃথিবীর মূল উপাদান ও পরিবারের প্রধান কারিগর। যুগে যুগে এই নারীই পরম মমতাময়ী মা, স্নেহের বোন, আদরের কন্যা, নির্ভরশীলতার অনুপম আধার স্ত্রী। নারী শুধু পৃথিবীতে টিকে থাকার অনিবার্য একক নয়। এই পৃথিবীর স্থিতিশলীতা আর কল্যাণকর রূপায়নের মূল চালিকা শক্তি। তাই, পৃথিবীর জন্য নারী জাতিকে বাদ দিয়ে যে পরিকল্পনা রচিত হবে তা অনিবার্যভাবে হবে অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ। নারীকে বাদ দিয়ে কেবল পুরুষের গঠিত কোন মানব সমাজ চিন্তাও করা যায় না। মুহাম্মাদ (সা.) ও অন্য সকল নবী আল্লাহর যে দীন প্রচার করে গেছেন তার দায়িত্ব পুরুষদের ন্যায় মহিলাদের উপরও সমভাবে অর্পিত ছিল। দায়িত্বের সীমায় তারতম্য অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু, ইসলামকে গ্রহণ করা, কায়েম করা, ইসলামের জন্য চেষ্টা সাধনা ও সংগ্রাম করা এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করার বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে পুরুষ-মহিলা উভয়ই সমান। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহিলা সাহাবীগণের বিপ্লবী জীবন একথাই প্রমাণ করে। ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহিলা সাহাবীগণ আত্মত্যাগের যে স্বাক্ষর রেখেছেন, শ্রদ্ধাভরে তা চিরস্মরণীয়। সারা আরব যখন কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কঠিন শৈত্যে ঝিমিয়ে পড়েছিল, তখন মক্কায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দা‘ওয়াতে সাড়া প্রদানে মহিলা সাহাবীগণের অবদান ছিল অভাবনীয়। ইসলাম গ্রহণ করে যে সকল মহিলা সাহাবী নিজেদেরকে অবনর্ণনীয় বিপদের মুখে ঠেলে দেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- খাদীজা (রা.) ও তাঁর কন্যাগণ যয়নাব, রোকাইয়্যা, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা (রা.) ইয়াসির (রা.)-এর মাতা সুমাইয়্যা (রা.) ফাতেমা বিনত আসাদ (রা.) স্বীয় পুত্র কন্যাগণসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। উম্মুল ফাদল (রা.) খাদীজা (রা.)-এর পর প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। উম্মু রূমান (রা.) কন্যা আসমা আয়েশা (রা.)-সহ ইসলাম গ্রহণ করে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী পুরুষ আবু বকর (রা.)-কে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেন। এছাড়া উম্মু আয়মন (রা.), ফাতিমা বিনত খাত্তাব (রা.) স্বামীসহ সাওদা বিনত যামআ, উম্মু সালামা, যয়নাব বিনত জাহাশ, উম্মু হাবীবা, খাওলা বিনত হাকীম, আসমা বিনত উমাইস (রা.), শিফা বিনত আবদুল্লাহ (রা.) নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলে খোদার দা‘ওয়াতী কাজে সহযোগিতা প্রদান করেন। হিজরতের মত কঠিন ক্ষেত্রেও মহিলা সাহাবীগণ পিছিয়ে নেই। নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ বছরের শুরুতে কুরাইশদের অত্যাচার উৎপীড়ন এতটা চরম পর্যায়ে পৌঁছালো যে মুসলমানদের জন্য মক্কায় বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়লো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীগণকে হাবশায় হিজরতের অনুমতি দান করেন। এ কাফেলায় ৮০ জন পুরুষ ও ১৯জন মহিলা ছিলেন। মহিলাদের মধ্যে সাওদা বিনত যাম‘আ, উম্মু সালামা, আসমা বিনত উমাইস, উম্মু হাবীবা (রা.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এরপর যখন মদীনায় হিজরত করার ডাক পড়লো, তখন মহিলারাও পুরুষদের ন্যায় যাবতীয় সহায় সম্পদ, মাতৃভূমি ও আপনজনকে ছেড়ে এবং সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে সত্যের তথা ইসলামের পক্ষ নিলেন। ইসলামের ইতিহাসে হিজরতের ক্ষেত্রে মহিলা সাহাবীগণের ত্যাগ ও কুরবানী, তাঁদের কষ্ট, সহিষ্ণুতার ঘটনা পরবর্তী মহিলাদের জন্য দৃষ্টান্ত। হাদীস হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাস্তব জীবন সত্তার অপর নাম। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুপম আদর্শ আমাদের নিকট পৌঁছেছে হাদীসের মাধ্যমে। হাদীস বর্ণনা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও মহিলা সাহাবীগণের অবদান অনস্বীকার্য। আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) মুকসিরীন তথা অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী সাতজন সাহাবীর মাঝে অন্যতম। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ২২১০টি। এছাড়াও উম্মু সালামা বিনত আবু উমাইয়্যা, আসমা বিনত ইয়াযীদ, মায়মূনা বিনত আল-হারিস (রা.), হাফসা বিনত উমার (রা.) আসমা বিনত আবু বকর (রা.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। আরবের ধনী শ্রেষ্ঠা মহিলা খাদীজা (রা.), যিনি সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন শুধু তাই নয়। বরং তিনিই মুহাম্মাদ (সা.)-কে সান্ত¦না দানের পাশাপাশি দীনের পতাকা উত্তোলন করার জন্য তাঁর সকল ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর ইন্তিকালে সবচেয়ে বেশী শোকাভিভূত হন। কারণ এজন্য নয় যে, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে গেলেন, বরং তার কারণ হলো, ইসলামের জন্য যিনি সবচেয়ে বেশী ত্যাগী, তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেলেন। মহিলা সাহাবীগণ ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য দান সদকার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় কোনভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। একদিন মদীনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি ঈদের সমাবেশে দান-খয়রাতের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলেন। উক্ত সমাবেশে মহিলারা ছিলেন। তাঁরা তাঁদের হাতের বালা, কানের দুল, গলার হার, হাতের আংটি খুলে খুলে রাসূলে কারীমের হাতে তুলে দেন। আসমা বিনত আবু বকর (রা.)-এর ছিল একটি মাত্র দাসী। তিনি সেটি বিক্রি করে সকল অর্থ দান করে দেন। উম্মুল মু’মিনীন যায়নাব বিনত জাহাশ (রা.) নিজ হাতে চামড়া দাবাগাত করতেন এবং তাঁর বিক্রয়লব্ধ অর্থ গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। হাফসা বিনত উমার (রা.) মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সকল বিষয়-সম্পত্তি গরীব মিসকীনদের জন্য ওয়াকফ করে দেন। যয়নাব বিনত খুযায়মা (রা.) এত বেশী দান করতেন যে তাঁকে উম্মুল মাসাকীন বা গরীব মিসকীনদের মা বলা হতো। সাফিয়্যা বিনত হুয়াঈ ইবন আখতাব (রা.) তাঁর ব্যক্তিগত গৃহখানি তাঁর জীবদ্দশায়ই দান করে দেন। ইসলামের অনুসারীদের উপর কঠিন থেকে কঠিনতর দূর্যোগের সময় অতিবাহিত হয়েছে। এমন কোন ধরনের নির্যাতন নেই যা তাঁদের উপর চালানো হয়নি। কাটার উপর দিয়ে টেনে হিচড়ে নেওয়া হয়েছে, উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, উত্তপ্ত লৌহ শলাকা দিয়ে কারো কারো দেহে দাগ দেওয়া হয়েছে, কঠোর ভাবে প্রহার করা হয়েছে। এ ধরনের নির্যাতন পুরুষদের ন্যায় নারীদেরও সহ্য করতে হয়েছে। বরঞ্চ মহিলাদের চেয়ে বেশী কষ্ট, বিপদ মুসিবত ও যুলুম ভোগের দৃষ্টান্ত পুরুষরাও পেশ করতে পারেনি। তাঁরা ছিলেন এমন সত্যনিষ্ঠ মহিলা যাদেরকে কোন চেষ্টা তদবীর দ্বারাই ইসলাম থেকে বিচ্যুত ও বিচলিত করা যায়নি। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে দাসী লুবাইনাকে তাঁর মনিব মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে থেমে যেতেন, এবং বলতেন, তোমার প্রতি দয়া ও করুণাবশতঃ থেমে যাইনি, ক্লান্ত হয়ে থেমেছি। লুবাইনা (রা.)ও ছাড়ার পাত্রী নন। তিনি বলতেন, আপনি ইসলাম গ্রহণ না করলে আল্লাহও আপনাকে এমন শাস্তি দেবেন। এমনিভাবে যিন্নীরার (স্ত্রীর দাসী) উপরও কঠোর নির্যাতন চালানে হতো। উম্মু শুরাইক (রা.)-কে রুটি ও মধু খাইয়ে দুপুরের প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত বালুর উপর রাখা হতো। পিপাসায় বুক শুকিয়ে যেত, এক ফোটা পানির জন্য চিৎকার করতেন, পানি দেওয়া হতো না। উমার (রা.)-এর বোন ইসলাম গ্রহণ করলেন। সেকথা তাঁর কানে গেলে এমন নির্দয়ভাবে তাঁকে মারপিট করেন যে, তাঁর সারা দেহ রক্তে ভিজে যায়। তারপরেও তিনি বিন্দুমাত্র টললেন না। উমার (রা.)-এর মুখের উপর সাফ বলে দিলেন, যা ইচ্ছা করুন আমি ইসলাম গ্রহণ করেই ফেলেছি। বোনের রক্তমাখা মুখ উমার (রা.)-এর মনকে নাড়া দেয়। তিনি সেখান থেকে সোজা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে চলে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। সাহাবীগণের সাথে মহিলা সাহাবীগণ শুধু অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও যুলুম-অত্যাচার সহ্য করেননি, বরং শাহাদাতের নাজরানা তারাই প্রথম, পেশ করেছেন। সুমাইয়্যা (রা.) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন মক্কার কাফিররা তাঁর উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায়। মক্কার উত্তপ্ত বালুর মধ্যে লোহার বর্ম পরিয়ে দুপুরের রোদে দাঁড় করিয়ে রাখতো। তারপরও তিনি ইসলামের উপর অটল থাকতেন। একদিন দুপুরের রোদে লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত বালুর উপর উপুড় করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) সেই পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। সুমাইয়্যা (রা.)-কে বললেন : ধৈর্য ধর। জান্নাতই হবে তোমার ঠিকানা। এত অত্যাচার করেও কাফেররা তৃপ্ত হয়নি। অবশেষে আবূ জাহল বর্শা বিদ্ধ করে তাঁকে শহীদ করে দেয়। পুরুষ সাহাবীগণ যখন ঈমান আনলেন তখন কাফিরদের সাথে তাঁদের সকল আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু এতে তাঁদের ঈমানী শক্তিতে কোন রকম তারতম্য সৃষ্টি হয়নি। মহিলা সাহাবীগণের অবস্থা এ ব্যাপারে পুরুষ সাহাবীগণের চেয়ে বেশী নাজুক ছিল। মানুষ যদিও তার সকল আত্মীয়-বন্ধুর সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, তবে একজন নারীর জীবনে সকল নির্ভরশীলতা স্বামীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। জীবনের কোন অবস্থায়ই সে স্বামীর উপর নির্ভরতা ছাড়া চলতে পারে না। পিতা পুত্রের সাথে, পুত্র পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলতে পারে। কিন্তু একজন নারী স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও মহিলা সাহাবীগণ দীনের জন্য এমন এক স্পর্শকাতর সম্পর্ককেও ছিন্ন করে ফেলেছেন এবং বিছিন্ন হয়ে গেছেন। আয়েশা (রা.) বলেছেন- “আমরা এমন কোন মুহাজির মহিলার কথা জানি না। যে ঈমান এনে আবার মুরতাদ হয়েছে।” পুরুষদের ক্ষেত্রে মুরতাদ হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। উম্মে হাবীবা (রা.)ও তাঁর স্বামী উবায়দুল্লাহ বিনত জাহাশ দীনের উপর ঈমান আনেন এবং অন্যান্য মুসলমানদের সাথে হাবশার হিজরত করেন। স্বামী উবায়দুল্লাহ দুর্বল চিত্তের লোক ছিলেন। দীনের জন্য এত কষ্ট স্বীকার করতে অপ্রস্তুত হয়ে তিনি ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর স্ত্রী উম্মে হাবীবার পাহাড় সম ঈমানের কাছে তার সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। উম্মে হাবীবা আল্লাহর পথে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকেন। এক বিন্দু নড়েননি । স্ত্রী কাছে নিজের আদর্শিক ব্যর্থতার আঘাত তার মনে খুব বেশী ভাবে লেগেছিল। সে কল্পনাও করেননি যে বিদেশ বিভুঁইয়ে একজন সাধারণ মহিলা স্বামীর আদেশ উপেক্ষা করতে সাহস করবে। উম্মে হাবীবা সে সাহস প্রদর্শন করলেন। স্বামীর জন্য আদর্শ ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলেন না। উবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ এর প্রতিশোধ নিলো এক হীন পন্থায়। স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়াল নবদীক্ষিত ঈসায়ী স্বামী। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা উম্মে হাবীবা (রা.) অনুভব করলেন, কিন্তু তাতে তিনি মুষড়ে পড়লেন না। উম্মে হাবীবা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন সকল ভালোবাসার উর্ধ্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য ভালোবাসা। মহিলা সাহাবীগণ খুব সহজে শুধু ইসলাম গ্রহণ করেননি, বরং তাঁরা অতি উৎসাহের সাথে ইসলামের প্রচারও করেছেন। সহীহ বুখারীর তায়াম্মুম অধ্যায়ে এসেছে, সাহাবায়ে কিরাম তাঁদের এক অভিযানে একজন মহিলাকে বন্দী করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পানি নেন, তবে তাঁর মূল্য পরিশোধ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এমন সততায় মহিলাটি ঈমান আনেন এবং তাঁর প্রভাবে তাঁর গোটা গোত্র মুসলমান হয়ে যায়। ইসলামের প্রথম যুগের এই সুযোগ্য মহিলারা তাঁদের সন্তানদেরকে এমন যোগ্য করে গড়ে তোলেন যে, বিশ্ববাসী অবাক-বিস্ময়ে আজও তাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখে। তাঁরা ইসলামকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন। খিলাফতের প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা, সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, মোটকথা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এমন সব উদাহরণ পেশ করেন যা আজো মানুষকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। যেমন : আসমা বিনত আবী বকর ও তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ ইবন আয-যুবাইর, ফাতিমা বিনত আসাদ ও তাঁর ছেলে আলী (রা.), সাফিয়্যা বিনত আব্দিল মুত্তালিব ও তাঁর ছেলে জাফর, উম্মু আইমান (রা.) ও তাঁর ছেলে উসামা (রা.) এবং আরো অনেকে তাঁদের সন্তানদেরকে সুুুচারুরূপে গড়ে তোলেন। ইসলামের প্রভাব তাঁদের অন্তরে এতো গভীর ছিল যে, তাঁদের সমস্ত ভালোবাসা ও ঘৃণা একমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। ছেলেরা যতো সম্পদশালী ও অর্থোপার্জনকারী হোক না কেন আল্লাহর আনুগত্যের প্রেরণায় উজ্জ¦ীবিত না হলে মায়েদের দৃষ্টিতে তাঁদের কোন গুরুত্ব থাকতো না। স্বামীরা যদি মু’মিন না হতো এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর সহযোগী না হতো, তবে তারা স্ত্রীদের যথা সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসলেও স্ত্রীদের কাছে তার কোন কদর থাকতো না। এ ছিলো সেই যুগের অবস্থা, যখন মহিলারা বুঝতো যে, তাঁরাও ইসলাম প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্বের সমান অংশীদার। ‘‘ইসলামের সোনালী যুগে যুদ্ধ বিগ্রহে পুরুষেরা যেখানে তীর বর্শা নিক্ষেপ করে এবং তরবারী চালিয়ে যুদ্ধ করেছে ও হতাহত হয়েছে, সেখানে নারীরা আহতদের পানি খাইয়েছে, ব্যাণ্ডেজ করেছে ও সান্ত¦না দিয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম মহিলারা যে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন তা আজও কিংবদন্তী। আল্লাহও তাঁর রাসুলের ভালোবাসায় এমন সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে, তা শুনলে ঈমান তাজা হয়ে ওঠে। মহিয়সী সাহাবীগণ আমরু বিল মা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার এর দায়িত্ব সে যুগে পালন করেছেন। তাঁদের জ্বালাময়ী বক্তব্য উৎসাহ যুগিয়েছে তাঁদের স্বামী, সন্তান ও ভাইকে, খর্ব করে দিয়েছে জালিমের দম্ভ ও অহঙ্কারকে। ইসলামের ইতিহাসে যে যুগে পুরুষদের ঈমানী শক্তি দূর্বল হয়ে গিয়েছিল, তখনও এমন মহিলাদের সন্ধান পাওয়া যায়, যাদেরকে নিয়ে মুসলমানরা গর্ববোধ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসায় তাঁরা এমন সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যা অবিস্মরনীয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ক্ষেত্রে সর্বোপরি দা‘য়ী ইলাল্লাহ হিসেবে মহিলা সাহাবীগণ হচ্ছেন আমাদের জন্য আদর্শ, আমাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁরা আমাদেরকে দেখিয়েছেন কিভাবে দা‘য়ী ইলাল্লাহ হতে হয়। কোন জাতি যখন নিজের ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে অন্য জাতির আদর্শ গ্রহণ করে, তখনই তাঁর পতন অনিবার্য হয়ে দাড়ায়। বর্তমান মুসলিম মহিলাদের অবস্থাও হয়েছে ঠিক তাই। ফলে পাশ্চাত্যের মত মুসলিম সমাজেও অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এ সময় মহিলা সাহাবীগণের গৌরবজ্জ্বল জীবনালেখ্য, বিশেষতঃ ইসলামী দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান তুলে ধরা জরুরী। আমাদের জানা মতে এ ধরণের কোন গবেষণা কর্ম এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সম্পন্ন হয়নি। আরবী ভাষায় মহিলা সাহাবীগণের জীবনীর উপর অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হলেও ইসলামী দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে মহিলা সাহাবীগণের অবদানকে স্বাতন্ত্রিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। তাই এ বিষয়ে উচ্চ গবেষণার প্রয়োজন উপলব্ধি করে বিষয়টির উপর গবেষণা করতে আগ্রহী হই। বাংলাদেশী তথা বিশ্ব নারী সমাজকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার এক মহতী প্রয়াসকে সামনে রেখে এ গবেষণা কর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত। এ সন্দর্ভে স্বীকৃত গবেষণা পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়েছে। এর তথ্য উপাত্ত যতটা সম্ভব মৌলিক তথা প্রামাণ্য হাদীস গ্রন্থ, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, দেশী ও বিদেশী জার্নাল, সাময়িকী ইত্যাদি থেকে সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মহিলা সাহাবীগণের সংখ্যা অধিক হওয়ায় এ অভিসন্দর্ভে উম্মুল মু’মিনীনগণ, বানাতে রাসূলগণ (সা.) সহ মোট ৪৫জন মহিলা সাহাবীগণের অবদান সম্পর্কে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ইসলামী দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে যারা প্রত্যক্ষভাবে রাসূল (সা.)-কে সহযোগিতা করেছেন। মহিলা সাহাবীগণের দা‘ওয়াত বিষয়ক অবদান তুলে ধরতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঘটনা বিস্তারিত নিয়ে আসা হয়েছে। অভিসন্দর্ভটি নিম্নোক্ত চারটি অধ্যায় ও প্রতিটি অধ্যায়কে কয়েকটি করে পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করে আলোচনার প্রয়াস চালানো হয়েছে এবং প্রতিটি পরিচ্ছেদ শেষে গবেষকের নিজস্ব মতামত সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। অভিসন্দর্ভটিতে সকল ক্ষেত্রে লিখিত তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশন করা হয়েছে। তথ্য সমূহ একাধিক সূত্র থেকে সংগ্রহ করে উহার যথার্থতা ও প্রামাণিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর সন্নিবেশ করা হয়েছে। এরপরও এটাই যে কেবলমাত্র এ ক্ষেত্রে পূর্নাঙ্গ ও চূড়ান্ত কর্ম এমন দাবী আমি করছি না। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো সূক্ষ্ম গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত গবেষণা কর্ম আত্ম প্রকাশ করতে পারে এটাই যৌক্তিক। আরবী প্রতিবর্ণায়নের ক্ষেত্রে একটা স্বীকৃত প্রতিবর্ণায়ন নীতির অনুসরণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র অপরিহার্য ক্ষেত্রে পুনরুক্তি রয়েছে। এ গবেষণা কর্ম দ্বারা একদিকে জানা যাবে মহিলা সাহাবীগণের জীবনালেখ্য তেমনি অন্যদিকে বর্তমান সময়ের নির্যাতিতা-নিগৃহীতা নারী সমাজ খুঁজে পাবে তাদের চলার পথের পাথেয়, ইসলামী দা‘ওয়াতের পথে নিবেদিত সংগ্রামী নারীগণ দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে মহিলা সাহাবীগণের যুগান্তকারী অবদান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে পারবে এবং ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পাবে।