ফ্ল্যাপে লিখা কথা ‘জীবনবৃত্তে’ মূলত লেখকের স্মৃতিকথা। স্মৃতির আঁধারেই বিধৃত হয়েছে ইতিহাস। শব্দের শৈলীতে জীবনের যে জলছবি এঁকেছেন তা সময়ের দর্পনে তিনি ধরে রাখতে চেয়েছেন জীবনবোধের মনোগ্রাহী বিশ্লেষণের মাধ্যমে। আর সে অনুপুক্সক্ষ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে বিগত কয়েক দশকের সমাজ চিত্র, সোনালী শৈশবের হারানো দিন, বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য-পুথি সাহিত্য, চৈত্র-সংক্রান্তির সংস্কৃতি ও লেখকের বাবার দিনলিপির খেরোখাতা। তাতে উঠে এসেছে মানুষের জীবনবোধ ও মনোলোকের পরিশীলিত ইতিহাস। লেখনীতে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও নেত্রকোনা জেলার কিছু কিংবদন্তীতুল্য ও আলোকিত মানুষের গল্প গাঁথা। তাদের নিয়ে লেখকের সহজ-সরল, সাবলীল স্মৃতিচারণ বইটিকে আরো তথ্যসমৃদ্ধ করেছে। স্মৃতিকথা, জীবনবোধ ও আত্মজীবনীমূলক উনিশটি স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা ‘জীবনবৃত্তে’ বইটি লেখকের প্রথম প্রকাশনা। প্রিয় কবি ‘নির্মলেন্দু গুণ’ তার সুন্দর লেখনী দিয়ে এ বইয়ের ভূমিকা পর্বটি করেছেন ঋদ্ধ। আশাকরি বইটি পাঠক মহলে সমাদৃত হবে।
জীবনবৃত্তে বইয়ের ভূমিকায় কবি ‘নির্মলেন্দু গুণ’ যা লিখেছেন:
হামিদুর রহমানের জীবনবৃত্তে: জীবনী কথাটার আভিধানসিদ্ধ অর্থ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির জীবনের ঘটনাবলী বিষয়ক পুস্তক। জীবনের যেসব ঘটনা মনে আছে, যে সকল বিষয়কে তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে- তার নির্বাচিত রচনারূপ। ইংরেজী ভাষার এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে বায়োগ্রাফি। জীবনী কথাটার সমার্থক শব্দ বাংলা ভাষায় আরও অনেক রয়েছে। ফলে, বাংলা ভাষায় আমাদের সমাজের বিশিষ্টজনেরা তাদের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত গ্রন্থের নামকরণের ক্ষেত্রে যতটা স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, পৃথিবীর অন্য-ভাষায় তেমনটি আছে বলে জানি না। আমি নিজেই আমার প্রকাশিতব্য আত্মজীবনীর শিরোনাম নির্বাচন নিয়ে দ্বিধার ভিতরে রয়েছি। কী নাম রাখবো? কোন নামটি মানাবে ভালো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আত্মকথা, জীবনকথা, জীবনচরিত, জীবনবৃত্তান্ত, জীবনস্মৃতি, জীবনসংগ্রাম, আমার জীবন? মন স্থির করতে পারছি না। ক্ষণেক মনে হচ্ছে সবই তো ভালো। আবার কিয়ৎপরেই মনে হচ্ছে, সবই খারাপ। নাম রাখছি আর কাটছি। শেষে ভাবছি, আরও তো সময় আছে, দেখা যাক। জানি, গ্রন্থপ্রকাশের পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এই নামনির্বাচন প্রক্রিয়া। আমার প্রকাশিতব্য জীবনের ঘটনাবলী বিষয়ক পুস্তকটির নামকরণ নিয়ে যখন আমি হিমশিম খাচ্ছি, তখন আমার প্রায় ভুলতে-বসা একজন লেখক বন্ধু, হামিদুর রহমান তাঁর রচিত আত্মজীবনীগ্রন্থ নিয়ে হাজির হয়েছেন আমার কাছে। তিনি চান, আমি তাঁর রচিত আত্মজৈবনিক গ্রন্থটির একটি ছোট্ট ভূমিকা লিখে দেই। দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো না। ভুলেই গিয়েছিলাম। তিনিই স্মরণ করিয়ে দিলেন আমাদের জীবনের অতিক্রান্ত অভিন্ন স্মৃতিকে। মনে পড়লো, আমরা দু’জনই প্রায় সমানবয়সী। ১৯৬০-১৯৬৫-র দিকে, গ্রামে থাকাকালে, নেত্রকোনা থেকে প্রকাশিত এবং সুসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকার মধ্য দিয়েই সাহিত্যজগতে আমাদের ভীরু পায়ের কর্দমাক্ত রথযাত্রা শুরু হয়েছিলো। আমরা দু’জন একই পত্রিকার লেখকই নই, একই সাহিত্যগুরুর শিষ্যও বটে। শুরুতেই তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে, তিনি তাঁর জীবনীগ্রন্থের নাম নির্বাচনের দায় আমার ওপর না চাপিয়ে দিয়ে, তিনি নিজেই তাঁর জীবনগাথার জন্য একটি নতুন নাম নির্বাচন করেছেন- জীবনবৃত্তে। নামটা অভিনবই বটে। আমি পূর্বে শুনিনি। এই নতুন নামটির জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই। তিনটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর জীবনবৃত্তের ডালি। অধ্যায়-১ : আমার ছেলেবেলা / অধ্যায়-২ : বাবার কথা / অধ্যায়-৩ : আলোকিত মানুষের সাথে তৃতীয় অধ্যায়ে নেত্রকোণার গৌরব ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ও সুসাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী, পল্লীকবি রওশন ইজদানী, মরমী-কবি জালাল খাঁ, নেত্রকোণার লোকসাহিত্য সংগ্রাহক সিরাজউদ্দীন কাশিমপুরীর মতো চিরকালের মানুষদের পাশে আমার মতো ক্ষণকালের অভাজনেরও ঠাঁই মিলেছে রচয়িতার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে। আমার প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শনের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর প্রতিষ্ঠাতা বর্ষীয়ান জননেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং একজন সাহিত্যানুরাগী মানুষ হিসেবে হুছাইন আহমদও তাঁর জীবনবৃত্তে স্থান পেয়েছেন। হামিদুর রহমানের ‘জীবনবৃত্তে’ বন্দী হয়েছে আমাদের পেছনে ফেলে-আসা শতবর্ষের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের ষ্ফটিকস্বচ্ছ জলছবি। আমি এই গ্রন্থ রচনার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই এবং গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও প্রসংশা কামনা করি।