অনন্যতা সৃষ্টিতে তিনি যেমন অগ্রগামী, তেমনই উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্বাচনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সর্বগ্রাহী। তাঁর কথাকাহিনী কেবলমাত্র চেনাপরিচিত মধ্যবিত্ত জীবনের ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ থাকেনি। চারদিকের পরিপার্শ্ব ছাড়িয়ে তিনি উপন্যাসের উপাদান খুঁজে এনেছেন ইতিহাস থেকে, অনতি অতীত থেকে, এমনকী সুদূরতম পুরাণলোক থেকে। এই সর্বচারিতা তাঁর সৃষ্টির জগৎকে ঋদ্ধ করেছে, চিত্রবিচিত্র আস্বাদনে ভরিয়ে তুলেছে। এই গ্রন্থে সংকলিত পাঁচটি প্রণয়কাহিনী লেখক সংগ্রহ করেছেন পুরাণ ও লোকপুরাণ থেকে প্রতিটি কাহিনীরই কেন্দ্রবিন্দু প্রেম। মানুষের আবহমান জীবনে প্রেম এক অনস্বীকার্য জীবন-সংরাগ। মন এবং দেহসঞ্জাত হলেও প্রেমের স্থান সহজাত প্রবৃত্তিগুলির অনেক ওপরে। তাই ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু হলেও প্রেম অমর হয়ে থাকে। তখন প্রেমকে মানুষ শাশ্বত বলে গ্রহণ করে। পুরাণবাহিত রাধা ও কৃষ্ণ, নল ও দময়ন্তী, শকুন্তলা ও দুষ্মন্ত কিংবা পাশ্চাত্যের ত্রিস্তান ও ইসল্ট প্রমুখ চরিত্রগুলির প্রেমকাহিনীর দ্বন্দ্ব-বিষাদ, আনন্দ-যন্ত্রণা আধুনিক যুগেও সমান আবেদনময়। লেখক সেই চিরন্তনী প্রেমকথাকে পুনর্বার পরিবেশন করেছেন অপূর্ব সৃষ্টিকুশলতায়। কল্পলোকের মায়া-আবরণ থাকা সত্ত্বেও চরিত্রগুলি হয়ে উঠেছে পরিচিত জীবনের অভিমুখী, আরও বেশি রক্ত-মাংসের ও জীবন্ত। তবে কাহিনীগুলি নতুনভাবে রচনা করার সময় লেখক পুরাণ এবং মধ্যযুগের লোকগাথায় যে-অলৌকিক রস ও ভক্তিবিহ্বলতার প্রাবল্য ছিল তাকে সযত্নে পরিহার করেছেন। এতে অবশ্য মূলকাহিনীর কোনও হানি ঘটেনি। বরং তা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। যেমন রাধা-কৃষ্ণর প্রণয়কাহিনীর কৃষ্ণ কদাপি দেবতা নন। তাঁর বহু দেবোপম লীলাকে সরিয়ে রেখে বৃন্দাবনের যে-কৃষ্ণ সাধারণ মানুষের মতন, যিনি দুরন্ত রাখাল এবং রাধার রূপমুগ্ধ প্রেমিক, শুধু তাঁরই প্রণয়কথা বলেছেন লেখক। সমস্ত কাব্যপুরাণ মন্থন করে সেই চিরকালের প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে এই রসসমৃদ্ধ ভাষ্যটি রচনা করেছেন আপন ভাষায়। অন্যান্য আখ্যানগুলিতেও লেখক একই ধারা অবলম্বন করেছেন। তাঁর রচনার সৌকর্যে প্রতিটি কাহিনী হয়ে উঠেছে প্রেমেরই মতন অনন্ত ও অনির্বচনীয়। একালের আবার সর্বকালের। এই প্রেম-আখ্যান সংকলনে আছে: সোনালি দুঃখ, দময়ন্তী, রাধাকৃষ্ণ, শকুন্তলা ও স্বপ্নবাসবদত্তা।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।