বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮-১৮৯৪ বাঙ্গালার ইতিহাস' সাহেবেরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীলন্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত ও গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান্, ষ্টুয়ার্ট প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি ; সে কেবল সাধ-পুরাণ মাত্র। ভারতবর্ষীয়দিগের যে ইতিহাস নাই, তাহার বিশেষ কারণ আছে। কতকটা ভারতবর্ষীয় জড়প্রকৃতির বলে প্রপীড়িত হইয়া, কতকটা আদৌ দস্যুজাতীয়দিগের ভয়ে ভীত হইয়া ভারতবর্ষীয়েরা ঘোরতর দেবভক্ত। বিপদে পড়িলেই দেবতার প্রতি ভয় বা ভক্তি জন্মে। যে কারণেই হউক, জগতের যাবতীয় কর্ম দৈব্যানুকম্পায় সাধিত হয়, ইহা তাহাদিগের বিশ্বাস। ইহলোকের যাবতীয় অমঙ্গল দেবতার অপ্রসন্নতায় ঘটে, ইহাও তাহাদিগের বিশ্বাস । এজন্য শুভের নাম “দৈব,” অশুভের নাম “দুৰ্দ্দৈব”। এরূপ মানসিক গতির ফল এই যে, ভারতবর্ষীয়েরা অত্যন্ত বিনীত ; সাংসারিক ঘটনাবলীর কর্তা আপনাদিগকে মনে করেন না ; দেবতাই সর্বত্র সাক্ষাৎ কর্তা বিবেচনা করেন। এজন্য তাহারা দেবতাদিগেরই ইতিহাস কীর্তনে প্রবৃত্ত ; পুরাণেতিহাসে কেবল দেবকীর্তিই বিবৃত করিয়াছেন। যেখানে মনুষ্যকীর্তি বর্ণিত হইয়াছে, সেখানে সে মনুষ্যগণ হয় দেবতার আংশিক অবতার, নয় দেবতানুগৃহীত; সেখানে দৈবের সংকীর্তনই উদ্দেশ্য। মনুষ্য কেহ নহে, মনুষ্য কোন কার্যেরই কর্তা নহে, অতএব মনুষ্যের প্রকৃত কীর্তিবর্ণনে প্রয়োজন নাই। এ বিনীত মানসিক ভাব ও দেবভক্তি অস্মজ্জাতির ইতিহাস না থাকার কারণ। ইউরোপীয়েরা অত্যন্ত গর্বিত ; তাহারা মনে করেন, আমরা যাহা করিতেছি, ইহা আমাদিগেরই কীর্তি, আমরা যদি হাই তুলি, তাহাও বিশ্বসংসারে অক্ষয় কীর্তিস্বরূপ চিরকাল আখ্যাত হওয়া কর্তব্য, অতএব তাহাও লিখিয়া রাখা যাউক। এই জন্য গর্বিত জাতির ইতিহাসের বাহুল্য; এইজন্য আমাদের ইতিহাস নাই ।
জন্ম ১৯৩৯ সালে বাংলাদেশের খুলনা জেলায় । ১৯৪৭ সাল থেকেই কলকাতায় বড় হওয়া ও লেখাপড়া শেখা। ১৯৬১ সালে যুগান্তর পত্রিকা গোষ্ঠীর সাপ্তাহিক ‘অমৃত' পত্রিকায় যোগ দেন । তারপর থেকে যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা এবং সংবাদ প্রতিদিন-এ চাকরি জীবন কাটিয়ে ২০০২ সাল থেকে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে ব্যস্ত। ১৯৮৭ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপর স্বতন্ত্র দুখানি বই লেখেন—যা ১৯৯৯ সালে একখণ্ডে চব্বিশ পরগনা-উত্তর-দক্ষিণ-সুন্দরবন' নামে প্রকাশিত। পরবর্তীকালে দে'জ ইতিহাস গ্রন্থমালায় সম্পাদনা করেছেন—যশোহর খুলনার ইতিহাস (২ খণ্ড), ঢাকার ইতিহাস (২ খণ্ড), বিক্রমপুর- রামপালের ইতিহাস, বৃহত্তর বাখরগঞ্জের ইতিহাস, সুবর্ণগ্রামের ইতিহাস, দার্জিলিঙের ইতিহাস, কোচবিহারের ইতিহাস, ফরিদপুরের ইতিহাস, নোয়াখালি ও সন্দ্বীপের ইতিহাস, রাজসাহীর ইতিহাস, মেদিনীপুরের ইতিহাস (৩ খণ্ড), চট্টগ্রামের ইতিহাস, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস (২ খণ্ড)। সিপাহি বিদ্রোহের ১৫০ বছর, বঙ্গভঙ্গ ও সমকালীন বঙ্গসমাজ,বাঙ্গালার ইতিহাস (২ খণ্ড), সিলেটের ইতিহাস, নদীয়ার ইতিহাস, বীরভূমের ইতিহাস, সাঁওতাল বিদ্রোহ— সমাজ ও জীবন, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (নগেন্দ্রনাথ বসু) সিরাজদ্দৌলা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়), বাঙ্গালার ইতিহাস- নবাবী আমল (কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়), মধ্যযুগে বাঙ্গালা (কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়), গৌড় রাজমালা (রমাপ্রসাদ চন্দ), উত্তরবঙ্গ : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, গৌড় লেখমালা (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়), অগ্রন্থিত অক্ষয়কুমার, এবং অন্যান্য গ্রন্থ। ‘গণ-আন্দোলনের ছয় দশক' নামে দুটি মূল্যবান গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার আরও কয়েকখানি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়।