"প্রিয় নবী (সা.) এর প্রিয় সুন্নত" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ শীতের সকাল। চালাকচর মনােহরদী। ডিস্ট্রিক্ট রােডের মােড়ে এলােমেলাে দাড়িয়ে আছে কয়েকটি রিক্সা। রিক্সাগুলাের হুড তােলা। রিক্সার চালকরা হুডতােলা রিক্সার ভেতর বসে আছে জড়ােসড়াে হয়ে। এভাবে থাকলে উম পাওয়া পায়। একটা ঘুম ঘুম আরামভাব হয়। ‘ভাই যাবেন? এক রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাে এক যুবক। বেচারা রিক্সাওয়ালা আয়েশী ভঙ্গিতে হাই তুলছিলাে। যাত্রীর প্রশ্নে যেন চমকে উঠলাে। ছােট ছােট চোখে তার দিকে তাকালাে। হা-না কিছুই বললাে না। আবার হাই তুলে ঝিমুতে লাগলাে। ‘এই যে ভাই মির্জাপুর যাবেন? সুফী সাহেবের বাড়ি? এবার রিক্সাওয়ালা নড়ে চড়ে বসলাে। তার ঝিমুনিভাব যেন কেটে গেলাে। রিক্সা থেকে নামতে নামতে ব্যস্তমস্ত হয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাে, কই যাইবেন? সুফী সাবের বাড়ি? উড়ুইন (উঠুন)। যুবক কিছুটা হকচকিয়ে গেলাে। “সুফী সাহেবের বাড়ি’ শব্দটার মধ্যে যে এমন টনিক লুকিয়ে আছে এটা সে কল্পনা করেনি। কত ভাই? ভাড়া কত? ‘উডুইনসে। বাড়া বাড়া কইরেন না। রিক্সাওয়ালা বিরক্তি প্রকাশ করলাে কথা না বাড়িয়ে যুবক রিক্সায় উঠে পড়লাে। রিক্সা চলা শুরু করলাে। রিক্সাওয়ালার পা দুটোর সঙ্গে ঠোট দুটোও নড়ছে অনবরত। সুফী সাহেবকে নিয়ে এক ‘খুসিসি বয়ান। সুফী সাহেবের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালােবাসার বিনয়াবনত প্রকাশ ঘটছে তার আঞ্চলিক ভাষার আটপৌঢ়ে অভিব্যক্তিতে। রিক্সা থেকে নামার পর বেচারা ভাড়াও নিলাে না। তাহলে সুফী সাহেবের বাড়িতে আসা মেহমানের প্রতি অসম্মান করা হবে। সুফী সাহেবের বাড়িতে আসা আগত অপরিচিত কোন মেহমানকে যদি এতটা খাতির করা যায় তাহলে সুফী সাহেবের প্রতি কেমন খাতির যত্ন ছিলাে এই মানুষগুলির? অতি স্বাভাবিক প্রশ্ন যুবককে নাড়িয়ে দিলাে। সুফী আকবর আলী সাহেবের বাড়ি। দু’চালা দুটি ঘর। একটার প্রায় ভঙ্গুর অবস্থা। আরেকটা আসবাবপত্রহীন বৈঠক ঘর। ঢাকা থেকে সুফী সাহেবের আত্মীয় আসার সংবাদ এর মধ্যে চাওর হয়ে গেছে। লােকজন তার সঙ্গে দেখা করতে আসছে। কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে। সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতাে ব্যাপার। এমন অনাড়ম্বর বিত্তহীন মানুষটির প্রতি সাধারণ মানুষের কেন এতাে অনুরাগ? ‘যে আল্লাহর হয়ে যায় আল্লাহ তার জন্য হয়ে যান, সমস্ত মাখলুকও তার জন্য হয়ে যায়’-এরই সাক্ষাতপ্রমাণ শাহ্ সুফী আকবর আলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। সুন্নাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাস্তব নমুনা ছিলেন তিনি। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে শত শত মানুষ এই ভঙ্গুর চালা ঘরে আসতাে তাঁর কাছ থেকে দুআ নিতে। আলেম-উলামা, ব্যবসায়ি, রাজনীতিবিদ, বিপদগ্রস্ত মানুষসহ সব পেশার সব দল-মতের মানুষ তার সাক্ষাতপ্রার্থী ছিলাে। তিনি ছিলেন হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ‘মাজাযে বায়আত প্রাপ্ত। তাঁর নামে হযরত থানভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির হাতে লেখা অনেক চিঠি এখনও সংরক্ষিত আছে তাঁর বড় মেয়ের জামাই প্রধান খলীফা শায়খুল হাদীস মাওলানা ওসমান গনী আফরাদ সাহেবের কাছে। যিনি প্রিয় নবী আলাইহি এর প্রিয় সুন্নত'-এর রচয়িতা। তাঁকে দেখল তার দুটো কথা শুনলে মুখ থেকে এই সরল মন্তব্য বেরিয়ে আসবে-সুফী সাহেবের যােগ্য জামাই। ‘আসিন ইলা-মান আসা-আ ইলায়কা’ (যে তােমাকে কষ্ট দেয় তাকে তুমি শান্তি দাও।)-এই হাদীসের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। মাওলানা ওসমান গনীর চব্বিশ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্ত সুন্নতের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময়তায়- জ্যোতির্ময়তায় উদ্ভাসিত। যে কারণে তাঁর এই প্রিয় নবীজীর প্রিয় সুন্নত’ নিছক একটি রচনাই নয়; বরং এর প্রতিটি ছত্র জুড়ে রয়েছে ‘আমলী যিন্দেগীর তাজা রস স্বাদ-গন্ধের আলােকিত ছোঁয়া। শুধু তাই নয় করাচির হযরত হাকীম আখতার সাহেব রহ. এর পেয়ারে নাবিকে পেয়ারে সুন্নত নামক গ্রন্থের বিশেষ ছোঁয়াও বইটিকে অন্য এক উচ্চতায় উন্নীত করেছে। গ্রন্থটি ফর্মা তিনেকের ছােট হলেও এটাকে অবলম্বন করেই মাওলানা ওসমান গনী আফরাদ দামাত বারাকাতুহুম এই দীর্ঘ রচনা পত্রস্থ করেছেন। মানব শরীরের জন্য হৃৎপিণ্ড যেমন, ইসলামের সামগ্রিক আমলের শুদ্ধতা ও গ্রহণ যােগ্যতার জন্যও সুন্নতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেমন অপরিহার্য শর্ত। সুন্নত পালনে আমলের মধ্যে যে নূর ও হেদায়েতের সজীব-শুদ্ধ পাওয়া যায় এই বাস্তব অভিজ্ঞতাসঞ্জাত তথ্যটুকু এই বইয়ে পরিবেশন করা হয়েছে বড় মহব্বত আর সরল ভাষায়। সিন্ধু সেঁচে মুক্তো আনার মতাে বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ পাঠকের জন্য বাড়তি আয়ােজন বলা যায়। কারণ, এগুলাের বর্ণনা বাংলাভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থগুলােতে খুব একটা পাওয়া যায় না। উচ্চারণ ও অর্থসহ বেশ কিছু দুআ ও আমলও এতে পরিবেশিত হয়েছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, ‘প্রিয় নবী এলাএর প্রিয় সুন্নত’ বইটি এক অনবদ্য সংকলন।