“সায়েন্স ফিকশান সমগ্র-৬ষ্ঠ খণ্ড" বইটির ফ্ল্যাপের কথাঃ বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় এখন সায়েন্স ফিকশান লিখছেন অনেকে। তাঁদের পুরােধা হলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বলতে গেলে এক হাতে সাহিত্যের এই ধারাটিকে বাংলাভাষায় গ্রহণযােগ্য এবং জনপ্রিয় করেছেন এই লেখক। বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, আদিপর্ব। থেকেই দুই ধরনের সায়েন্স ফিকশান লিখছেন লেখকরা। জুল ভের্ন ধারা এবং এইচ. জি. ওয়েলসের ধারা বলা যায়। জুল ভের্ন ধারার লেখকদের ফিকশানে। বিজ্ঞান থাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে। বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত থাকে। অন্যদিকে ওয়েলস ধারার ফিকশান লেখকরা বিজ্ঞানের ধার ধারেন না অতটা। বিজ্ঞানের মােড়কে এঁরা আসলে লেখেন লাগামছাড়া বিজ্ঞানভিত্তিক রূপকথা। সায়েন্স ফিকশান না, সায়েন্স ফ্যান্টাসি এসব। কমিক সুপার হিরােদের কাহিনির মতাে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিজে বিজ্ঞানী, অধ্যাপক। আটঘাটের সুলুক সন্ধান রাখেন বিজ্ঞানের। সায়েন্স ফ্যান্টাসি না, তিনি লেখেন সায়েন্স ফিকশান। জুল ভের্ন ধারার লেখক বলা যায় তাঁকে। শুরু ‘কপােট্রনিক সুখদুঃখ’ দিয়ে, ইতােমধ্যে প্রায় পঞ্চাশটির মতাে সায়েন্স ফিকশান তিনি লিখেছেন। মুদ্রণের পর মুদ্রণ হয় তাঁর বইয়ের। পাঠক, সব বয়সের মানুষ। সহজ এবং টানটান গদ্য। রােমাঞ্চকর বর্ণনাভঙ্গি। কল্পনা আর বিজ্ঞানকে একাকার করে দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখেন এই লেখক। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা যদি তার কোনাে সায়েন্স ফিকশান পড়তেন, নিশ্চিত বলতেন, ‘আনপুটডাউনেবল!’ বাংলা ভাষাভাষী ফিকশান পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তাঁর নতুন সায়েন্স ফিকশানের জন্য। বাংলা ভাষার আর কোনাে সায়েন্স ফিকশান লেখকই তার মতাে এতটা জনপ্রিয় হতে পারেননি। ভূমিকাঃ আমার ছয় নম্বর সায়েন্স ফিকশান সমগ্রটি প্রকাশিত হল। যেহেতু নিয়ম করে রেখেছি আটটি বই নিয়ে একটি সমগ্র বের করব তাই এটি বের হতে সময় নিয়েছে পাঁচ বছর। সব মিলিয়ে এখন মােট সায়েন্স ফিকশানের সংখ্যা আটচল্লিশ—অর্থাৎ কোনােভাবে আর দুটি সায়েন্স ফিকশান লিখতে পারলে হাফ সেঞ্চুরি পুরাে হবে! আমার জন্য এটি অনেক বড় একটি ব্যাপার, নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। একই সাথে দুর্ভাবনায় ভুগি, যেহেতু আমার কিছুই মনে থাকে না, তাই ঘুরেফিরে একই সায়েন্স ফিকশান বারবার লিখে ফেলছি তাে? যখন আমি সায়েন্স ফিকশান লেখা শুরু করেছিলাম তখন এই দেশে সায়েন্স ফিকশানের লেখক খুব বেশি ছিল না। এখন দেখে আমার খুব ভালাে লাগে প্রতি বছর অনেকগুলাে করে সায়েন্স ফিকশান বের হচ্ছে, অনেকেই নিয়মিতভাবে লিখছে। এদেশে সায়েন্স ফিকশান সােসাইটি হয়েছে, শুধু তাই নয়, বাংলা একাডেমি এটাকে সাহিত্যের মৌলিক একটি ধারা হিসেবে বিবেচনা করে সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া শুরু করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম সায়েন্স ফিকশান মেরি শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন লেখার এটি দুইশত বৎসর, সেই নিয়ে সারা পৃথিবীতে কত হইচই শুরু হয়েছে দেখে খুব ভালাে লাগে। এই সংকলনের প্রথম বইটি হচ্ছে ‘ব্ল্যাকহােলের বাচ্চা’! ব্ল্যাকহােল হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের স্বীকৃত একটি বিশেষ পরিস্থিতি, পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। সেই ব্ল্যাকহােলের বাচ্চা থাকা সম্ভব কি না সেটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে কিন্তু আমি সেটি নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমার এই উপন্যাসে আমি কল্পনা করে নিয়েছি ভর দিয়ে তৈরি হয় ব্ল্যাকহােল আর প্রচলিত ভরের বাইরে যে ভর রয়েছে সেই ভর দিয়ে তৈরি হয় ব্ল্যাকহােলের বাচ্চা! বিজ্ঞানীরা আমার এই ব্যাখ্যা শুনে হার্টফেল করতে পারেন কিন্তু আমি তাদের হার্টের অবস্থা দিয়ে দুর্ভাবনা করিনি! এই বইয়ের মূল চরিত্রকে দিয়ে একটি ব্ল্যাকহােলের বাচ্চা তৈরি করিয়ে সেটা নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প ফেঁদে বসেছি! মূল চরিত্রটি বাচ্চা একটি ছেলে—মনেপ্রাণে বিজ্ঞানী! অবশ্যই গল্পটি সিরিয়াস সায়েন্স ফিকশান নয়, কৌতুকের ভঙ্গিতে লেখা হালকা একটা সায়েন্স ফিকশান! তবে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে এই উপন্যাসটির কোন অংশটি আমি আলাদাভাবে দেখেছি? তাহলে বলব এই বইটির প্রচ্ছদ। এটি আমার একমাত্র সায়েন্স ফিকশান যার প্রচ্ছদটি আমার নিজের আঁকা!
বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী পাঠকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি মূলত এ দেশের একজন বিখ্যাত লেখক, পদার্থবিদ এবং শিক্ষাবিদ। কিশোর সাহিত্য, শিশুতোষ গ্রন্থ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, গণিত বিষয়ক বই এর জন্য খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা বাবা ফয়জুর রহমানের চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলাতেই তিনি পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রী অজর্নের উদ্দেশ্যে স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি সম্পন্ন করে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ ল্যাবেও গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সবসময়ই এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের কাছে বিশেষ আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। কিশোর সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক অজস্র গ্রন্থ দিয়ে তিনি আলোকিত করে তুলেছেন এদেশের অগণিত কিশোর-কিশোরীর মনোজগত। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমূহ, যেমন- দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদ, আমি তপু, শান্তা পরিবার, দস্যি ক’জন ইত্যাদি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তার বেশ কিছু গল্প পরবর্তীতে নাটক ও চলচ্চিত্র হিসেবে টিভি পর্দায় স্থান করে নিয়েছে। তিনি একজন বিশিষ্ট কলামিস্টও। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডও তাঁর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর বই সমগ্র সকল বইপড়ুয়াকেই আকৃষ্ট করে। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহুবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (২০০৪) এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (২০০৫) সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক (২০০২), শেলটেক সাহিত্য পদক (২০০৩), ইউরো শিশুসাহিত্য পদকসহ (২০০৪) অগণিত পুরষ্কার অর্জন করেছেন গুণী এই সাহিত্যিক।