ছোটগল্পের সংজ্ঞায়ন ও বৈশিষ্ট্য এডগার অ্যালান পোয়ের মতে, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে। আবার এইচ জি ওয়েলস বলেছেন যে ছোটগল্প সাধারণত ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।[১] ছোটগল্পে জীবনের সামগ্রিক দিকটি উপন্যাসের মতো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত না হয়ে বরং এর খণ্ডাংশকে পরিবেশিত হয়। এজন্য ছোটগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড় হয়ে থাকে। সংগত কারণেই এতে পাত্রপাত্রী বা চরিত্রের সংখ্যা খুবই সীমিত হয়। ছোটগল্পের প্রারম্ভ ও প্রাক্কাল সাধারণত খানিকটা নাটকীয় হয়। রবীন্দ্রনাথ ও ছোটগল্পের ধারণা বাংলা ছোটগল্প ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সোনার তরী' কাব্যের যে 'বর্ষাযাপন' কবিতাটি প্রায়শই উদ্ধৃত হয়ে থাকে তা নিম্নরূপ:[২] ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা নিতান্ত সহজ সরল, সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা,ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ। জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত, অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল, অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা, কত ভাব, কত ভয় ভুল- এই পদ্যখণ্ডে ছোটগল্পের যে সকল গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে তা বহু ছোটগল্পের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এটিই এর সার্বিক গুণবিচারের মাপকাঠি নয়। এ সকল গুণাগুণের অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য সমন্বিত ছোটগল্প প্রায়শই লিখিত হয়ে থাকে। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ছোটগল্প এমন হতে হবে যে "শেষ হইয়াও হইল না শেষ", অর্থাৎ গল্প শেষ হয়ে গেলেও যাতে রেশ থেকে যায়। বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের উত্থান গল্পগুচ্ছ নামীয় গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে সকল ছোটগল্প সংকলিত সেগুলো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প হিসাবে অদ্যাবধি চিহ্নিত এবং বহুল পঠিত। বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ। তার 'ঘাটের কথা' ছোটগল্পটি বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে। অতঃপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বনফুল, (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়), বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, জগদীশ গুপ্ত, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, মনোজ বসু, হুমায়ূন আহমেদ, শিবরাম চক্রবর্তী প্রমুখের রচনানৈপুণ্যে বাংলা ছোটগল্প নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। ছোটগল্পের শ্রেণিবিভাগ প্রেমবিষয়ক : এসব গল্পে প্রেম ও রোমান্স প্রাধান্য পায়। যেমনঃ ইভান তুর্গেনেভের The Distruct Doctor; বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারাণী; রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়, একরাত্রি; মানিকের সর্পিল শিউলিমালা [নজরুল] ইত্যাদি। সামাজিক : সামাজিক প্রতিবেশ ও বিশেষ সমাজের রূপায়ণ ফুটে ওঠে এসব গল্পে। যেমনঃ রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার, তারাশঙ্করের পিতাপুত্র প্রভৃতি। প্রকৃতি ও মানুষ : এসব গল্পে সাধারণতঃ প্রকৃতির পটভূমিতে চরিত্রাঙ্কন করা হয়। উদাহরণস্বরূপঃ রবীন্দ্রনাথের তারাপদ, মনোজ বসুর বনমর্মর। অতিপ্রাকৃত : এ ধরনের গল্পে অতিপ্রাকৃত-ভাব বা রহস্য-আচ্ছন্নতা লক্ষ করা যায়। উদাহরণঃ রবীন্দ্রনাথের নিশীথে, ক্ষুধিতপাষাণ, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্কট। হাস্যরসাত্মক : হাস্যরস ও নিখাঁদ বিনোদনদানই এই গল্পগুলোতে প্রাধান্য পায়। যেমনঃ রবীন্দ্রনাথের অধ্যাপক, রাজশেখর বসুর খোকার কাণ্ড, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কায়ার কল্প, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যমনস্ক চোর। উদ্ভট : এই গল্পগুলোতে অসম্ভব বা অবাস্তব কাহিনী বর্ণিত হয়। উদাহরণ: বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নারায়ণী সেনা, কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভগবতীর পলায়ন ইত্যাদি। সাংকেতিক বা প্রতীকী : গল্পের পাত্রপাত্রী বা পরিবেশকে না বুঝিয়ে সাংকেতিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থান বা চরিত্রকে বোঝানো হয় বা বার্তা প্রদান করা হয় এ ধরনের গল্পে। এরকম গল্প হচ্ছে: জর্জ অরওয়েলের Animal Farm, রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ, গুপ্তধন ইত্যাদি। ঐতিহাসিক : এই গল্পগুলোতে কোনও একটি বিশেষ ঐতিহাসিক কালে সংঘটিত ঘটনা বর্ণিত হয়। যেমনঃ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চুয়াচন্দন। বৈজ্ঞানিক : বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে এ ধরনের গল্প রচিত হয়। উদাহরণস্বরূপঃ এইচ জি ওয়েলসের The Stolen Bacillus; প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবিশ্বাস্য, হিমালয়ের চূড়ায়; সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু ও ফ্র্যাংকেনস্ট্যাইন, মরুরহস্য; মুহম্মদ জাফর ইকবালের বেজি, আমড়া ও ক্রাব নেবুলা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশ্বমামা ও অহি-নকুল, নীল মানুষের কাহিনি ইত্যাদি। গার্হস্থ্য : এই গল্পগুলোতে পারিবারিক ও গৃহজীবন প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এ ধরনের গল্পের ভেতর রয়েছেঃ রবীন্দ্রনাথের ব্যবধান, বনফুলের তিলোত্তমা ইত্যাদি। মনস্তাত্ত্বিক : এসব গল্প সাধারণতঃ নর-নারীর মনস্তত্ত্ব ও মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে রচিত হয়ে থাকে। যেমনঃ শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টোপ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রতিশোধ ইত্যাদি। মনুষ্যতর : মনুষ্য নয় এমন, অর্থাৎ প্রাণী বা অন্য জীবকে কেন্দ্র করে এসব গল্প লিখিত হয়। এরকম গল্প হচ্ছেঃ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঘিনী, তারাশঙ্করের নারী ও নাগিনী। বাস্তবনিষ্ঠ : এসব গল্পে সাধারণতঃ জীবনের কোনও ঘটনা বা দিক অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ও অকপট ভাষায় প্রকাশিত হয়। যেমনঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নমুনা, প্রাগৈতিহাসিক; অচিন্ত্য সেনের বস্ত্র; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তারাবিবির মরদপোলা, দুধেভাতে উৎপাত, পায়ের নিচে জল। ডিটেকটিভ গল্প : এই গল্পগুলোতে পুলিশি তদন্ত ও সত্যানুসন্ধানের রোমাঞ্চকর বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে আর্থার কোনান ডয়েলের The Red-Headed League, Dorothy Sayers; নীহাররঞ্জন গুপ্তের সংকেত; পরশুরামের নীল তারা, সমরেশ বসুর আর এক ছায়া উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।