মাত্র বারো বছর বয়স থেকে শুরু করে আশি বছর পর্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যে তিনি যেসব কাব্য রচনা করেছেন, কারো কারো মতে, এ সময়টিই তাঁর কবি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় । কবির এই সময়েরই প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মানসী'। এটি রচিত ও প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে। এ সময়ের অন্যান্য কাব্যগন্থের মধ্যে রয়েছে, 'সোনার তরী, ‘চিত্রা' ও 'চৈতালি'। মানসী রবীন্দ্রনাথের প্রথম সার্থক কাব্যগ্রন্থ। তাঁর প্রকৃত শিল্পীজীবন ‘মানসী’ থেকেই শুরু । চিত্রকর্ম এবং সঙ্গীতধর্মের অপূর্ব সমন্বয়ে কবি সার্থক ধ্বনিসমৃদ্ধ শব্দ প্রয়োগ, শব্দের কারুকার্যে তাঁর ভাব ও কল্পনাকে রূপ দিয়েছেন । কবির হৃদয়ে শব্দ, স্পর্শ, রূপ-রস প্রতিনিয়তই নানাভাবে, নানা রূপে জন্ম দিয়েছে। সেই ভাব ও অনুভূতি কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। এই ভাব ও এবং ছন্দের প্রকাশই কবির মানসীর ভেতর ও বাইরের মিলনে যে আনন্দ মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে তাতেই তাঁর প্রাণের পূর্ণ প্রকাশ সম্ভব। তিনি কবিতায় বলেছেন, এই চিরজীবন তাই আর কিছু আজ নাই । রচি শুধু অসীমের সীমা । কথা দিয়ে ভাষা দিয়ে তাহে ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা । এই কাব্যগ্রন্থে কবি নতুন জীবনের অনুস্থান করেছেন, ভাবে ও ছন্দে । যে ভাব কবিকে উদ্বেলিত করতো সেই ভাবই প্রকাশ পেল নবতর ছন্দমাধুর্যে, রোমান্টিক চেতনার অপূর্ব বিলাসে, নতুন সৃষ্টির সন্ধানে। কবির অন্তরে একটি দ্বন্দ্ব দেখা দিল, এই দ্বন্দই কবিকে নতুন চেতনার মুখোমুখি করে । বস্তুকে প্রকাশ করার যে রীতি তাই চিত্ররীতি। আর এই বস্তু ভাবনাকে অন্তর রসে সিক্ত করে দেহহীন লাবণ্য বিলাসে অপূর্ব মাধুর্যময় করে প্রকাশ করার নামই হলো সাঙ্গীতিক পন্থা। এই চিত্রময়তা ও সঙ্গীতময়তা যা আইডিয়েল এবং রিয়েলের দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছুই নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারিনে আমার মনে সুখ-দুঃখ, বিরহ- মিলন পূর্ণ ভালবাসা প্রবল, না সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাংখা প্রবল?’ এই যে সৌন্দর্যের চেষ্টা তিনি করেছেন। কিন্তু শিল্পীসত্ত্বা পরিতৃপ্ত হয়নি ৷ কবি বলেছেন, ‘তা ভাল করে ভেবে দেখতে গেলে মানসীর ভালবাসার অংশটুকুই কাব্য, কথা বড় রকমের, সুন্দর রকমের খেলা মাত্র- ওর আসল সত্যি কথাটুকু হচ্ছে এই, মানুষ কী চায় তা সে কিছু জানে না
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।