নীলচে কাচ দিয়ে ঘেরা ‘লাহিড়ী'স লেজারগ্রাফিকস'-এর এই লম্বা কামরাটার একদিকে দেওয়াল ঘেঁষে পর পর সাতটা কম্পিউটার। প্রতিটি মেশিনের সামনে একজন করে তরুণ বা তরুণী। তারা খুব মগ্ন হয়ে কম্পোজ করে চলেছে। একেবারে কোণের দিকে বসেছে সুতপা। তার কম্পিউটারের পাশে থাক- দেওয়া বাংলা পাণ্ডুলিপি। কপি মিলিয়ে মিলিয়ে অক্ষর লাগানো বোতাম টিপে যাচ্ছে সে। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে লাইনের পর লাইন ফুটে উঠছে। কম্পোজের কাজে সে এমনই রপ্ত যে হারমোনিয়ামের রিডে ঝড় তোলার মতো দুরন্ত গতিতে তার আঙুল চলতে থাকে। সুতপার বয়স আটাশ-উনত্রিশ। শ্যামবর্ণ হলেও বেশি সুশ্রী। এই বয়সে বাঙালি মেয়েদের চেহারায় সূক্ষ্ম ভাঙন ধরে। চোরা বানের মতো শরীরে ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে সুতপার তেমন কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না। স্বাস্থ্য এখনও অটুট। তার ত্বকে নতুন পাতার মতো টাটকা লাবণ্য। ঘন চুল কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা। বড় বড় কালো চোখ দু'টিতে শান্ত, গভীর দৃষ্টি। পরনে রঙিন সালোয়ার কামিজ। তবে সেগুলোর রং ক্যাটকেটে চড়া নয়। চোখজুড়ানো। কপালে গোলাকার রঙিন টিপ। বাঁ হাতে চামড়ার ব্যান্ডে চৌকো ঘড়ি। গলায় ছোট লকেটওলা সরু সোনার চেন। গয়না টয়না বলতে এটুকুই। খুঁটিয়ে লক্ষ করলে দেখা যাবে, তার ভরাট, মসৃণ মুখে কোথায় যেন চাপা রুক্ষতা রয়েছে। নাকি কঠোরতা? তবে এটুকু আন্দাজ করা যায়, এ মেয়ের সামনে বেচাল করলে পার পাওয়া যাবে না। কামরার আরেক দিকে বসে আছেন প্রদোষ লাহিড়ী। লেজারগ্রাফিকস'-এর মালিক। গোলগাল, ভারী চেহারা। চওড়া কপাল ৷ কাঁচাপাকা চুল পাতলা হয়ে এসেছে। মাঝারি হাইট। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, আমুদে মানুষ। সাজসজ্জার দিকে নজর নেই। পরনে ঢলঢলে শার্ট আর ট্রাউজার্স। শার্টটার দু'টো বোতাম নেই। গেঞ্জি পরতে খুব সম্ভব ভুলে গেছেন। বুকের অনেকটা অংশ তাই হাট করে খোলা । প্রদোষের সামনে মস্ত টেবলের ওপর প্রচুর ফাইল, নানা ধরনের কাগজপত্র। আর রয়েছে তিনটে ফোন, তার একটা মোবাইল। টেবলের ওধারে খানচারেক চেয়ার। নানা কাজে যারা আসে, ওগুলো তাদের বসার জন্য । প্রদোষের টেবলের পর এ ঘরের চওড়া কাচের পাল্লার দরজা। তারপর ট্রেসিং করার এক জোড়া মেশিন ।
তিনি অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) ঢাকা জেলায়, বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রামে ১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন, স্বাধীনতার পর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে চলে আসেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পূর্ব পার্বতী' (১৯৫৭)। উপন্যাস রচনার জন্য তিনি সারা জীবন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। 'সিন্ধুপারের পাখি'র জন্য ১৯৫৮ তে পেয়েছেন পুরস্কার, 'ক্রান্তিকাল' এর জন্য ২০০৩ এ অকাদেমি পুরস্কার। প্রফুল্ল রায় এর উদ্বাস্তু জীবনকেন্দ্রিক যে সমস্ত উপন্যাসগুলি রচিত সেগুলি হল ‘কেয়াপাতার নৌকা’ (২০০৩), ‘শতধারায় বয়ে যায়’ (২০০৮), ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ (২০১৪), ‘নোনা জল মিঠে মাটি’ (বাং ১৩৬৬)। ‘কেয়াপাতার নৌকা’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ আকারে এবং নামে আলাদা হলেও আসলে তিনটি উপন্যাস মিলেই একটি উপন্যাস, ‘কেয়াপাতার নৌকো’র পরবর্তী খণ্ড ‘শতধারায় বয়ে যায়’ এবং তারও পরবর্তী খণ্ড ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। তিনটি উপন্যাসই আকারে মহাকাব্যিক। অসামান্য ক্ষমতা সম্পন্ন এইঔপন্যাসিক সারা জীবন জুড়ে পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। 'সিন্ধু পারের পাখি'র জন্য ১৯৮৫ তে 'বঙ্কিম পুরস্কার', 'ক্রান্তিকাল' উপন্যাসের জন্য ২০০৩ এ পেয়েছেন 'সাহিত্য অকাদেমি' পুরস্কার, এছাড়াও 'রামকুমার ভুয়ালকা', পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড এর 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট', 'শরৎস্মৃতি', 'বি কে জে এ' ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তার গল্প উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে ৪৫টির মতো টেলিফিল্ম, টেলি-ধারাবাহিক, ফিচার-ফিল্ম। 'মোহনার দিকে' অবলম্বনে 'মোহনার দিকে' (১৯৮৪), 'আদমি আউ আউরত' (১৯৮৪), 'একান্ত আপন'(১৯৮৭), 'চরাচর'(১৯৯৪), 'টার্গেট' (১৯৯৭),'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' (২০০৩), 'ক্রান্তিকাল'(২০০৫) ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান 'Best ASEAN film Award', 'Netpac Award', ও 'Golden Lotus Award'পায়। 'ক্রান্তিকাল' পায় 'Indian compitional Special Mention' পুরস্কার।