“ভারতীয় মুসলমানদের সংকট” বইয়ের ভূমিকা ভারতীয় মুসলমানদের সংকট সম্বন্ধে এই অবলোকনটি ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের অর্থাৎ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের অন্তেই সমাপ্ত। আজকের পাঠকের কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে একদা মুসলমানরা বিখ্যাত ছিল। উদারতা ও সহিষ্ণুতার জন্য। মহান ইটালীয় রেনেসঁসের ধ্রুপদী ঐতিহাসিক বুর্থহার্ট তীর প্রসিদ্ধ গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডের ‘ধর্ম ও রেনেসঁসের আত্মা’ শীর্ষক অংশে মুসলমানদের উদারতা, সহিষ্ণুতা ও মানবিকতা কী ভাবে।” রেনেসঁসকে অনুপ্ৰাণিত করেছিল তার কথা লিখেছেন। ইউরোপীয় ইতিহাসের অন্যতম প্রধান প্রণেতা ফিশার তার মহাগ্রন্থের প্রথম ভাগে ইসলাম প্রসঙ্গে ১২শ অধ্যায়ে এবং পুনরায় মধ্যযুগীয় স্পেন প্রসঙ্গে ৩১শ অধ্যায়ে আরব মুসলিমদের উদারতা, পরমতগ্রহণশীলতা ও সভ্যতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তবে ওইসব গ্ৰন্থ লেখা হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে। সেকালে খুব কম মনীষীই ভেবেছিলেন যে এমনদিন আসবে যখন স্যামুয়েল পি হান্টিংটন খ্রিস্টান ও ইসলাম সভ্যতার সংঘর্ষের তত্ত্ব রচনা ও ব্যাখ্যা করবেন অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমা বর্ষণ করে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার নিদর্শনগুলি ধ্বংস করবে অথবা আফগানিস্তানের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করবে, কিংবা আক্রমণ চালাবে এবং জঙ্গি মুসলিম মৌলবাদী বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত করবে। ধর্মীয় মৌলবাদের উদভব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। Webster's Encyclopedic Unabridged Dictionary অনুসারে "fundamentalism' এর অর্থ a movement in American Protestantism that arose in the early part of the 20th century...' ইত্যাদি। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের অভিধানগুলোতেও ফাণ্ডামেন্টালিজম-এর প্রদত্ত অর্থ একই দ্যোতনাপূর্ণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানে ইংল্যাণ্ড-ফ্রান্সের রণক্লান্তির সুযোগে মার্কিন সরবরাহ-কৃত অর্থে ও অস্ত্ৰে বেন গুরিয়ন, ইশতাক শামির প্রমুখ জিয়নবাদী ইহুদিগণ বিস্ফোরণ, হত্যা প্রভৃতি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জোরে ১৯৪৮-এর ১৫ মে পূর্বতন প্যালেস্টাইনের বুকে ইজরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করেন আর কার্যত বিলোপ পায় প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড ও অধিকাংশ প্যালেস্টাইনীয় দেশচ্যুত হয়। অতঃপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একে একে পশ্চিম এশিয়ার ইংরেজ ও ফরাসি নিয়ন্ত্রিত খনিজ তৈল সমৃদ্ধ ক্ষেত্রগুলি নিজের অধীনে অথবা নিজের মনোনীত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অধীনে আনয়নে সচেষ্ট হয়। এই পর্ব থেকে মুসলিম মৌলবাদের উদ্ভব । পক্ষান্তরে মার্কিন মুলুকে মৌলবাদের উদ্ভবের সমকালেই ভারতেও আর্জধর্ম চেতনার প্রচ্ছদে গুজরাটি পাঞ্জাবি মরাঠা সমাজে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম। প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য এই গ্রন্থেই দিয়েছি। এ ছাড়া ‘ পরিচয় পত্রিকার মে-জুলাই ২০০২-এর বিপন্ন সময় বিষয়ক বিশেষ সংখ্যাতে আমি ‘আধুনিকতার আর-এক রূপ হিন্দু জাতীয়তাবাদ' নামক প্রবন্ধে যা বলেছি তা সংক্ষেপে এই যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই হচ্ছে মৌলবাদ যা আপাতদৃষ্টিতে অতীতের অভিমুখী হলেও আসলে ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থারই পরিণাম। অধুনাতন সংগঠনে প্রতিযোগিতায় মত্ত, ধর্মিকতার আড়ম্বরে উৎসবে আপ্লুত, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে অন্ধ সমাজ সর্বপ্রকার প্রতিযোগী, সুবিধার অংশীদার, ভিন্ন মতাবলম্বীর ও স্বতন্ত্র সত্তার নিমূলীকরণে উদ্যত এবং এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কাছে দারিদ্র্য নিবারণ, সমস্ত মানুষের বিকাশ ও সাম্য, স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছন্দ, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কে অহিংসা, শান্তি ও সম্প্রীতি, প্ৰতিস্বিক মর্যাদা, স্বতন্ত্রতা ও সৃষ্টিশীলতা অর্থহীন। স্বভাবতই এই পরিবেশে সংখ্যায় লঘু, বিত্তে লঘু, পেশিতে লঘু পরিশীলিত বুদ্ধিজীবী যুক্তিবাদী নির্বিরোধ শান্তিপ্রিয় কোনও মানুষই নিরাপদ নয়। এটা চিন্তার বিষয় যে ১৯৯২ সালে সূরাটের বর্বরতার দশ বছর পরে গুজরাটে আরও ব্যাপক বর্বরতা দেখা গেল। তবে কি বন্দোদরাবাসী গান্ধীবাদী হরষিত ভাই ১৯৮৫ সালে আমাকে যে বলেছিলেন সোমনাথ লুণ্ঠনের শোধ না হওয়া পর্যন্ত কোনও গুজরাটি শান্ত হতে পারে না সেই কথাটাই ঠিক? সেই জন্যই কি ২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারিতে গোধরাতে যে-কাণ্ড হয় সে-বিষয়ে বহু বিভ্রান্তিকর বিবরণ উৎপাদনাপূর্বক-যেন পূর্ব হাজার-হাজার মানুষ হত্যায়, অগ্নি-সংযোগে ও বিভিন্ন পৈশাচিক কাণ্ডে সক্রিয় অংশ নেয়। যারা সক্রিয় অংশ নেয় না তারাও অনেকে-হিংসার অবসাদকালে-ধৰ্ষিত ও বিধ্বস্ত হতভাগ্যদের গৃহ ও বিপণি লুণ্ঠন করে, কেউ কেউ মূল্যবান গাড়িতে আসে লুণ্ঠনে এবং যারা অকুস্থলে না থাকার জন্য এসব অপরাধে অংশ নিতে পারেনি তারাও দূর থেকে মানসিকভাবে ওইসব কাজে উৎসাহ ও সমর্থন জানায়। অপরাধী, অপরাধে সহযোগী ও অপরাধের মানসিক সমর্থক এবং হত্যায় হিংস্রতায় বিশ্বাসী এক বিশাল ভারতীয় সমাজ গড়ে উঠেছে। এমনকি গোধরাতে প্রকৃতই কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, কী ভাবে ঘটেছিল, কতজন মারা গিয়েছিল এসব বিষয়ে প্রচুর প্রশ্ন সত্ত্বেও গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রীও অনায়াসে বলেন যে গোধরা-কাণ্ডের জন্যই গুজরাটে পরবর্তী ঘটনাগুলি হয়, যেন তেমন হওয়াটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসংগত। এই পরিস্থিতিতে সংকট শুধু ভারতীয় মুসলমানদের নয়, সংকট সমস্ত ধর্মের ও সত্যে আগ্রহী মানুষের। এমনকি অপরাধীদেরও সংকট কারণ অপরাধীদের কাছে কোনও রকম প্ৰতিদ্বন্দ্বী বা সমকক্ষ অসহ্য। এই হিংস্র বাতাবরণে নিরপরাধ ও অপরাধী প্রত্যেক নাগরিকই বিপন্ন। অপরাধীরা অর্থে ও অস্ত্ৰে আত্মরক্ষায় সমর্থ পক্ষান্তরে নিরপরাধরা নিরস্ত্র ও অধিকাংশই নির্ধন এবং প্রেম ও বিশ্বাস, সত্য ও সাহসই তার সম্বল। এটা সর্বজনবিদিত যে সমস্ত উত্তেজনার শেষে ক্লান্তি অনিবাৰ্য, বিশেষত উত্তেজনা করে যদি প্রত্যাশিত সুফল না আসে, তাতে যদি রাজ্যের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাধারণ জীবন বিপর্যন্ত হয়, প্রশাসন ও সরকার অবান্তর প্রতিপন্ন হয় এবং তাতে যদি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিপোষক রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বজনমত তথা সভ্য জগৎ বিরূপ হয়। সুতরাং আমাদের কর্তব্য এখন অহিংসা, শান্তি, সম্প্রীতি ও সদভাবে বিশ্বাসকে বঁচিয়ে রাখা, অন্ধ রাত্রির ঝড়ঝঞার মধ্যে প্ৰাণের কম্পিত আলোকশিখাটিকে রক্ষা করা। এই বইটি শ্ৰীসবিতেন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে লেখা। তিনি নিজে গান্ধীবাদী ও সম্প্রীতির কর্মসূচিতে নিযুক্ত। তঁকে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই। সুরজিৎ দাশগুপ্ত "সুচেতন"৯৭এ রিজেন্ট এস্টেট ল কলকাতা ৭০০ ০৯২
ভারতীয় মুসলমানদের সংকট বইয়ের সূচী: * ঐতিহাসিকের দায়িত্ব * সংকটের সূচনা * সংকটের বিস্তার * সংকটের স্বরূপ