হেরা গুহাকে অবলম্বন করিয়া কোরানের আগমন। হেরাগুহায় প্রবেশ করিয়া ধ্যানস্থ না হইলে কেহই সত্য উদ্ধার করিতে সক্ষম হইবে না। অতএব যিনি হেরা গুহায় প্রবেশ করিয়া ধ্যান করিয়াছেন তিনি সত্য উদ্ধারকারী সাধক হইয়াছেন বা হইবেন। এই হেরা গুহা প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই বিদ্যমান রহিয়াছে। যেহেতু এই হেরা গুহা হইল একমাত্র জ্ঞান কেন্দ্র এবং যেহেতু এই হেরা গুহা বা জ্ঞান কেন্দ্র প্রত্যেক মানুষের নিজের মধ্যেই বিরাজিত সেইহেতু আত্মদর্শনে নিমজ্জিত না-হইয়া যে তফসীরই লেখা হউক না কেন তাহা বাহির হইতে আহরণ করা তফসীর হইবে; আত্মদর্শনের দ্বারা নির্ণীত সঠিক জীবন দর্শনমূলক তফসীর হইবে না। অতএব সত্য উদ্ধারকারী প্রজ্ঞাময় সাধনের দ্বারাই কোরানের সঠিক অনুবাদ ও ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব। ঐরূপ সাধক ছাড়া অন্যের দ্বারা বিজ্ঞানময় কোরানের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ত্রুটিপূর্ণ । এই কারণে শুধু ভাষাবিদ পন্ডিতের তফসীর কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নহে; যদি তাহা উক্তরূপ কোন সাধকের অভিব্যক্তি হইয়া না থাকে। দীর্ঘ দিনের ধ্যান-জনিত সালাতের মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জিত হয় সেই জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কাহাকেও কোরানের তফসীর করার অধিকার দেওয়া হয় নাই (৩ঃ৭ দ্রষ্টব্য)। আমরা ঐরূপ জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ হইতে প্রাপ্ত দুই-চারিটি মৌলিক কথার অনুসরণে এই তফসির প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিয়াছি যাহাতে কোরানের গভীর ভাবরাজ্যের দিকে পাঠকের অগ্রসর হওয়ার পথে সামান্য সাহায্য করিতে পারি । কোরানের সর্বত্রই ‘লা’ এর অভিব্যক্তি ফুটিয়া রহিয়াছে। 'লা' এর অনুশীলনের মধ্যে অর্থাৎ সালাতের গভীর অবস্থার মধ্যে শানে-মোহাম্মদ জাগ্রত এবং বিকশিত হইয়া উঠে । সকল নবিগণ ‘শানে মোহাম্মদ' এর ধারক এবং বাহক । নবিগণের প্রবর্তিত ‘লা’ এর প্রশিক্ষণ কোনকালেই সমাদৃত হয় নাই, বরং সকল যুগের সকল সম্প্রদায়ই ইহার বিরোধিতা করিয়াছে । ইহাদের মধ্যে মহানবির উম্মতের বিরোধিতা হইল অত্যন্ত ব্যাপক এবং তীব্র। ইনসানের জন্য মোহাম্মদী স্তর মর্যাদায় উচ্চতম স্তর। কতল কর্ম এই স্তরে পৌঁছিবার একমাত্র উপায়। কতলের কোন বিকল্প নাই। ‘কতল' অর্থ বিষয়রাশির মোহ সম্পূর্ণরূপে হত্যা করা, তথা মানব মনের কুফরী হত্যা করা । কুফরী অন্ধকার, অজ্ঞানতা এবং নফসানী জুলুম । কতল কর্ম মানুষকে লা-মোকামে উন্নীত করে। জান্নাত মুক্তিপথের গন্তব্য নয়। গন্তব্য লা-মোকাম । জান্নাত ইহার মধ্যবর্তী এক একটি অস্থায়ী অবস্থা। আধ্যাত্মবাদকে অস্বীকার করার জন্যই ভোগের মধ্যে ত্যাগের অনুশীলন, অর্থাৎ দায়েমী সালাতের অনুশীলন এবং প্রয়োজনীয়তা অস্বীকৃত হইয়াছে। ধর্ম বিধানের দুইটি স্তর। প্রথমটি হইল মানুষের আর্থসামাজিক কল্যাণের পথে সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা আনয়ন করা এবং সবার জন্য সর্বাঙ্গীন স্বার্থ ও সমৃদ্ধি রক্ষায় যত্নবান হওয়া, যাহাতে সর্বস্তরের মানুষ সামাজিকভাবে সচ্ছল ও সুন্দর জীবন যাপন করিয়া জান্নাতবাসী হইতে পারে । অপর স্তরটি চরম ও পরম স্তর । ইহা জীবোত্তর ‘লা' এর স্তর। এই স্তরে উত্তীর্ণ বা উন্নীত হইবার জন্য ধর্মরাশির প্রতি এমন সালাতের ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হয় যাহাতে কোন বিষয়ের প্রতি মোহ না জন্মায়। জগতবাসী এই স্তরে উন্নীত হইবার উপযুক্ত গভীর সালাত পালন করিতে অনিচ্ছুক। সকল যুগের নবি-রসুলগণ ইহার জন্যই প্রত্যাখ্যাত হইয়াছেন । কোরানের সূক্ষ্ম জীবন-দর্শন সর্ব-সাধারণের জ্ঞাতব্য বিষয় নহে। ইহা শুধুমাত্র মুক্তিপাগল সাধকদের জন্য । মুক্ত পুরুষগণ সমাজকে যেরূপ জীবন বিধান দান করিবেন তাহাই হইবে জনগণের ধর্ম বিধান। ধর্ম বিধান দানের অধিকার একমাত্র মুক্ত পুরুষগণের জন্যই সংরক্ষিত থাকিতে হইবে। ইহার ব্যতিক্রম হইলে সঠিক ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে ধর্মীয় শৃংখলা বজায় থাকিতে পারে না ।