‘অলাতচক্র’ বইয়ের ভূমিকা নয়ঃ আহমদ ছফা ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯৮৫ সালে। সাপ্তাহিক ‘নিপুণ’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য লেখাটি তাঁকে লিখতে হয়েছিল। শুরুর তারিখটি ছিল ১০ মে। মাত্র বারদিনের মাথায় লেখাটি তাঁকে শেষ করতে হয়েছিল। অনেকটা তাড়াহুড়োর মধ্যে। ব্যত্যয় ঘটলে এ পত্রিকার মাধ্যমে উপন্যাসটি আলোর মুখ দেখত না। উপন্যাসটি তো নিপুণে প্রকাশ পেল। কিন্তু লেখাটি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। নানাজনের আপত্তিও ছিল। তখনই তিনি ঠিক করেছিলেন উপন্যাসটি পুনরায় লিখবেন। এ কাজে তাঁকে নামতে হয়েছে আরও কয়েক বছর পরে। নানা জনের আপত্তির কারণে তিনি উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্রের নামও পরিবর্তন করেছিলেন। অনেক চড়াইউতরাই পেরিয়ে ১৯৯৩ সালে মুক্তধারা থেকে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এটা পাঠকের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। কিন্তু নিপুণে প্রকাশিত সেই আদিরূপটির কথা আমরা বিলকুল ভুলে গিয়েছিলাম। মানুষের অন্তদৃষ্টি প্রখর না হলে এমনতর হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন ভুলেননি, তিনি পণ্ডিত ড. সলিমুল্লাহ খান। তিনি আদিরূপটি খুঁজে পাবার জন্য যত্রতত্র চষে বেড়িয়েছেন। একসময় তিনি সফলও হয়েছেন। তাঁর মতে, আহমদ ছফার সাহিত্যে অলাতচক্রের আগের লেখাটির ঐতিহাসিক মূল্য কম নয়। তিনি লেখাটি উদ্ধারের পর তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এবং এ কে এম আতিকুজ্জামান সম্পাদিত পত্রিকা ‘অর্থে’ হুবহু ছেপেছেন কোন রকম পরিবর্তন, পরিমার্জন ছাড়াই। ড. খান তারই কোমল কপিট আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। যেই কারণে কোন রকম বাড়তি ভোগান্তিতে আমাদের পড়তে হয়নি। অর্থ পত্রিকার ছাপা লেখাটি আমরা অলাতচক্রের আদিরূপ হিসেবে অনেকটা কপি করেই এখানে জুড়ে দিলাম। ড. খানের অনুরোধে একাজটি করতে হল, তাঁর প্রতি সম্মান রেখে। পরিশিষ্টে তাঁর একটি মূল্যবান আলোচনাও সংযুক্ত করে দেয়া হল। এ লেখাটির মাধ্যমে অলাতচক্র উপন্যাসের আদি এবং নতুন দুটি রূপের সাদৃশ এবং বৈসাদৃশ্যের ক্ষেত্রেগুলো খুঁজে পেতে পাঠকদেরকে সাহায্য করবে। আশা করি। প্রকাশক
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।