"তিতাস একটি নদীর নাম" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: মালাে সম্প্রদায়ের শিক্ষিত সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর এই উপন্যাসের মধ্যে জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের মতাে চরম প্রাকৃতিক বিষয়গুলােকেও দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছেন। অন্যের নৌকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা সুবলের মতাে দরিদ্র জেলে থেকে শুরু করে উজানিনগরের বাঁশিরাম মােড়লের মতাে ধনী প্রতাপশালী জেলেদের কথা তিনি অনুপুঙ্খ উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন জেলে নারীদের অন্তহীন জীবনসংগ্রামের গল্প। জেলে সমাজের আশা-আকাঙ্খ, প্রচেষ্টা, ইচ্ছা, ঈর্ষা, বাসনা, উদ্যোগ, সবকিছুই অত্যন্ত মমতায় তিনি চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব প্রবণতা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের সকল জেলেদের সরলতা ও নদী নির্ভরতা। সমাজ চিত্রণে লেখক পুরােপুরি সফল। তবে এ সমাজ জেলে সম্প্রদায়ের সমাজ। অন্য সমাজ অর্থাৎ চাষী ও ব্যবসায়ীদের জীবনচিত্র অঙ্কনে লেখক বেশ দ্রুততার পরিচয় দিয়েছেন। লেখক জেলেদের জীবন আঁকায় যতটা সফল অতটা আর কিছুতেই নয়। জেলে সমাজের প্রতিটি প্রথা, পূজা, লােকজ নিয়মকানুন, বিশ্বাসকে তিনি দক্ষহাতে তুলে ধরেছেন পাঠকের উদ্দেশ্যে। হয়তাে ভাষা ব্যবহার অথবা বর্ণনার পরিমিতিতে লেখক অতটা দক্ষ নন। কিন্তু লেখকের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টা, সর্বোপরি বিষয়ানুগ অউঘাটনে লেখকের মুন্সীয়ানা অসামান্য। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি পড়তে গেলে মনে হয়, উনিশ শতকের প্রথমার্ধের কোন জেলে পল্লীর ভিতর থেকে পাঠক হেঁটে যাচ্ছেন। লেখক পরােক্ষে উজানিনগরের সুকদেবপুরের জেলেদের জীবনযাত্রাকে সমর্থন করেছেন। সেখানে জেলেরা যেমন মাছও ধরে তেমনই একহাতে চাষও করে। তাই যদি বা কখনাে নদী তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের আর না খেয়ে মরতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে কাদির ছাদিরের অবলম্বনে লেখক খাটি চাষী পরিবারের চিত্রও অঙ্কন করেছেন। সেখানেও হিন্দু মুসলমান অনেকটাই এক হয়ে গেছে। একদিকে চাষী জেলের সদ্ভাব, অন্যদিকে হিন্দু মুসলমানের একত্র সহযােগিতাপূর্ণ উদ্যোগে অনেক সঙ্কট মুহূর্তেই চলে যায়। সাহিত্যে ধর্মীয় সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ এই তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি। শরীয়তুল্লা-বাহারুল্লার সঙ্গে রামপ্রসাদের সম্পর্ক এবং জারিগান ও কালীপূজার প্রসঙ্গ এনে এ ধারণাকেই শক্ত ভিত্তিভূমি দিয়েছেন লেখক। কাদির-ছাদির ও বনমালী, রঘু ও অনন্ত অথবা জমিলা ও উদয়তারার মধ্যে লেখক এমন গভীর সম্পর্ক চিত্রিত করেছেন।
জন্ম ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গােকর্ণ গ্রামে এক মৎস্যজীবী পরিবারে। শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন। ১৯৩৩ সালে স্থানীয় অন্নদা। এইচ. ই. স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর অর্থোপার্জনের জন্য কলকাতায়। গমন। পেশাগত জীবনের শুরু ত্রিপুরা পত্রিকায়। এরপর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন নবশক্তি, মাসিক মােহাম্মদী, নবযুগ, আজাদ, কৃষক পত্রিকা ও সাময়িকীতে।। উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নামতার স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। আরভিং স্টোনের উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ-এর বাংলা । অনুবাদ তার আরও একটি উল্লেখযােগ্য সাহিত্য প্রয়াস। মৃত্যু ১৬ এপ্রিল, ১৯৫১।