গত শতাব্দীর ষাটের দশকের কথা। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সে সময় থেকেই আহমদ ছফাকে চিনি। কিছু কাগজপত্র বগলদাবা করে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ঘুরাঘুরি করতেন, শিক্ষকদের সাথে কথা বলতেন। মনে হতো তাঁদের কাছ থেকে কোনো পত্রিকা বা সাময়িকীর জন্য লেখা সংগ্রহ করতেই এই ঘুরাঘুরি। চলার পথে দু'একবার সালাম-কালামও হয়েছে। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এটা ঘুনাক্ষরেও জানতাম না। চলাফেরার ভঙ্গিমায় ক্ষিপ্রতা ছিল: কিন্তু ছিলেন খুবই মার্জিত। লেখক হিসেবে তাঁকে দূর থেকেই জানতাম। দু'একটি লেখা ছাড়া বেশি পড়ার সুযোগ তখনও হয়নি। চুয়াত্তরের অক্টোবরে কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে একটি লেখা বের হয়েছিল। লেখাটি পড়ে তাঁর ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। এর মধ্যে সময় অনেক গড়িয়ে গিয়েছে। তাঁর সাথে আর কোনো দেখা- সাক্ষাৎ হয়েছে কি না মনে পড়ে না। এক অর্থে তিনি ছিলেন আমার সতীর্থ; কারণ এক পর্যায়ে ছেদ পড়লেও তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা সম্মান শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছিলেন, যেটা আমি জানতাম না। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের এক কৃষক পরিবারে। ২০০০ সালের কথা। তিনি নিউ ইয়র্কে গিয়ে ক'দিন আমার বড় মেয়ে এবং জামাতার বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মেয়ে-জামাতার পক্ষ থেকে প্রেরিত কিছু কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য তাঁর বাসায় যেতে হয়েছিল। সাথে ছিল আমার কনিষ্ঠ ছেলে তানভীর সিরাজী। তিনি তখন বাংলা মোটরের কাছাকাছি ১২/১ ময়মনসিংহ রোডের একটি বাড়িতে থাকেন। অনেক আলাপ হলো একান্ত আন্তরিক পরিবেশে। আমাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। যে ছেলেটি চা-নাশতার ব্যবস্থা করল সে একজন খ্রিস্টান এবং তাঁর পালিত। অনেক আলাপের ফাঁকে তিনি একটি কথা বলেছিলেন যা এখনো মাঝে মাঝে স্মরণ করে বিস্মিত হই তাঁর সরলতার জন্য। বললেন 'দেখুন, সালেহ উদ্দীন আমার সব চেয়ে পছন্দের মানুষদের একজন। ওরা সবাই (সালেহ-রেজভীন পরিবার) ধর্মকর্মে ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। আমি তো সে ভাবে ধর্মকর্ম করি না। ভাবছিলাম ওরা আমাকে সে জন্য খারাপ ভাবে কিনা। কিন্তু না, ওদের আচরণে আদৌ কিছু ফুটে উঠেনি, বরং ওরা সাধ্যমতো আমার যত্ন করেছে। এটা আমি ভুলতে পারব না। মানুষ হিসেবে সত্যিই ওদের তুলনা নেই ।'