"টুনটুনি ও ছোটাচ্চু সমগ্র" বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে নেয়াঃ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০) ছিলেন ত্রিশ দশকের সর্বকনিষ্ঠ কথাকার। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই আপন প্রতিভার জোরে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে নিজের নামটি সুপরিচিত করে নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তিনি মূলত কাব্যচর্চা করতেন। বলতে কুণ্ঠা নেই, কাব্যচর্চার প্রভাব পড়েছে তার ছােটগল্পেও। এ কারণে তাঁর ছােটগল্পের ভাষা যেমন বর্ণবিত্বরসে ভেজা, তেমনি রঙে-বর্ণে ঐশ্চর্যময় এবং ব্যঞ্জনাময়। প্রাবন্ধিক অধ্যাপক বীরেন্দ্র দত্ত তার বাংলা ছােটগল্প : ‘প্রসঙ্গ ও প্রকরণ' গ্রন্থে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য স্বপ্নসিকতার ভিত্তি সম্পর্কে জানিয়েছেন-‘রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ার ফলেই কলেজে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সহপাঠী থাকার কালে বরিশালে বাস ঘটে। পার্টি প্রােগ্রামই রাজনীতির শেষ কথা নয়- এই বিশ্বাসে ক্রমশ সমাজবাদ ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া মানব-প্রীতিকে তিনি ব্রত বলে মনে করেন। রাজনীতি তাঁকে উত্তেজিত করে, কিন্তু মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা আরও তীব্র, গভীর হয়, ঘনিষ্ঠ সহজ রক্তের আত্মীয়তা এনে দেয়। এই মানসিকতাতেই ফরিদপুরে এসে প্রথম গল্পটি তিনি লেখেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় জীবনকে বড় বেশি ভালােবেসেছিলেন। জীবনের ক্ষয়-ক্ষতি সারিয়ে জীবনকে আপন করে ভালােবাসাই মনুষত্বের ধর্ম—এ সত্য তিনি বুঝেছিলেন বলেই তাঁর গল্পে সুস্থ মানবতাবােধ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। সঙ্কট সময়কালের ভেতরে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনে বেঁচে থাকাটাই যে একমাত্র সত্য তা বারবার তাঁর গল্পে বলেছেন। এই বাঁচা যে পেটের ক্ষুধা থেকে বাঁচা, যৌনতার বিকৃতি থেকে বাঁচা, মানুষের জন্য মানুষের বাঁচা, বিশ্বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠভাবে জীবনকে আলােকিত ক্লেদশূন্য করে বাঁচা এবং সর্বোপরি নরনারীর সম্পর্কের মধ্যে সুস্থ চেতনা ও কল্যাণমুখী হৃদয়ের স্পর্শ নিয়ে বাঁচা- তা বারে বারে আত্মসম্মানের দর্পণ নিয়ে অনেক গল্পের মধ্যেই স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করেছেন। জীবনকে ভালােবাসাই একমাত্র সত্য হিসেবে মনে এবং মেনে নিয়ে কালসচেতন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী মন্বন্তর, জীবন্ত দরিদ্রের প্রতি আভিঝাত্যের অবহেলা, দালালী প্রবঞ্চনা, ভাগ্যবিরূপ হতাসা, দাম্পত্যজীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রভৃতি বিষয় তাঁর গল্পের উপজীব্য করে তােলেন।
Narayan Gangopadhyay নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮ - ৬ নভেম্বর, ১৯৭০) একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক । জন্ম অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত) অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালিয়াডাঙ্গীতে। সাহিত্যে ছোটগল্প তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ছোটদের জন্য তাঁর সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র টেনিদা খুবই জনপ্রিয় । তাঁর লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প হল - ইতিহাস, নক্রচরিত, হাড়, বীতংস, রেকর্ড, টোপ, আদাব, প্রভৃতি।নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় দিনাজপুর জেলা স্কুল, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন। তার শিক্ষাকাল কাটে দিনাজপুর, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ, বরিশালের বিএম কলেজ ও কলকাতায়। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং ডক্টরেট ডিগ্রি নেন ১৯৬০ সালে। এরপর তিনি জলপাইগুড়ি কলেজ, সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ছোট গল্প বিষয়ে ডি.লিট ডিগ্রি লাভ করেন।