“বিনাতেলে রান্নাপদ্ধতি" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ আমি এ বইয়ের নাম দিয়েছি ‘বিনাতেলে রান্নাপদ্ধতি’ বা ‘খাদ্য দ্বারা হৃদরােগ নিয়ন্ত্রণ'। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি। সাধারণ ধারণা এই, বিনাতেলে ভালাে খাবার তৈরি করা যায় না। প্রায় সব পরিবারেই রান্নায় তেল ও প্রয়ােজনীয় মশলা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভারতে ও বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানির তেল- যেমন সাফোলাে, করলাে, রূপচাদা, ফ্রেশ, তীর, ধারা, ডালডা, সানড্রপ, সনােলা, পােস্টম্যান, মস্তান, পাম অয়েল, ফরচুন, নেচার ফ্রেশ, সান গােল্ড ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ভারতে রান্নায় ঘিয়ের ব্যবহারও হয়ে থাকে, যা দুধ থেকে তৈরি করা হয়। এ বইয়ে খাবার তৈরির যে পদ্ধতি জানানাে হয়েছে তা সম্পূর্ণ বিনাতেলে রান্নার। এজন্য একে ‘জিরাে অয়েল কুকিং' বলা হয়েছে। আমাদের এটা মনে রাখা দরকার, রান্নায় তেলের প্রয়োেগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের শরীরের জন্য কিছু ফ্যাটের প্রয়ােজন আছে, তা আমরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন খাবারে অদৃশ্য থাকা উৎস থেকে লাভ করতে পারি। প্রযুক্তিভাবে তৈরি উচ্চ ক্যালােরিযুক্ত তেলের প্রভাবকে নিঃশেষ করবার জন্য যতটা শারীরিক পরিশ্রম করা উচিত, আমাদের আধুনিক জীবন যাপনে প্রায়ই হয়ে ওঠে না। স্বাস্থ্যের ওপর প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করা অতিরিক্ত এনার্জিকে, যা কিনা চর্বিজাতীয় জিনিসে থাকে- যেমন পনীর, মাখন, ক্রিম আর মার্গারিন, তা ব্যায়াম দ্বারা কম করা যেতে পারে। আমরা দুধ থেকে প্রস্তুত জিনিসেরও পক্ষপাতী নই। কারণ এসবে বেশি মাত্রায় ফ্যাট থাকে। আমরা বেশিরভাগ লােকই জানি, ফ্যাট কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড রূপে হৃৎপিণ্ডের ধমনীগুলােতে জমে যায়। এটা মানব জাতির জন্য এক অত্যন্ত সাধারণ অথচ ভয়ানক রােগের কারণ হয়। যেটাকে করােনারি আর্টারি ডিজিজ বা হার্ট ব্লকেজ রােগ বলা হয়। সাধারণ ভাবে এ রােগকে চর্বির স্থূপ বা চর্বির দলা বলা যায়। আর চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ভাবে অ্যানজাইনা, আইকেমিয়া, করােনারি থ্রম্বােসিস, এমআইও বা স্ট্রোক, মাইয়ােকার্ডিয়াল ইনফারকেশন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। এ পুস্তকে যেসব খাদ্যের বিবরণ দেয়া হয়েছে, তা শুধু কোলেস্টেরল এবং ফ্যাট জমে ওঠাকে প্রতিরােধ করবে না, আগে থেকে জমে থাকা কোলেস্টেরল ও ফ্যাটের অপসারণ করবে। সাধারণ বিশ্বাস এই, একবার ব্লকেজ হলে তা অপসারণ বা বিলােপ করা যায় না, কিন্তু তা বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও প্রয়ােগের মাধ্যমে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন আমেরিকা, ইউরােপসহ এশিয়ার চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশে হার্ট ব্লকেজ অপসারণে আধুনিক মেডিসিন-মেশিন, আদর্শ জীবন-যাপন ও পরিকল্পিত খাদ্য-অভ্যাসের সমন্বিত চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
ডা. বিমল ছাজেড় উপমহাদেশের চিকিৎসাজগতে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারতে নন-ইনভেসিভ কার্ডিওলােজি ও বিনা অপারেশনে হৃদরােগ চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬১ সালে এক জৈনধর্ম পরিবারে তাঁর জন্ম। কলকাতা সেন্ট লরেন্স হাইস্কুলে পড়াশােনা শেষে ১৯৮৬ সালে কলকাতার আরজি কার মাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২৫ বছর বয়সে নয়াদিল্লির ডা. রাম মনােহর লেহিয়া হাসপাতালের হৃদরােগ বিভাগে কাজ শুরু করেন। সেখানে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা তাঁর জীবন-উপলব্ধি পরিবর্তন করে দেয়। ফলে হৃদরােগ চিকিৎসার বিষয়ে তাঁর ধ্যান-ধারণা নতুন মােড় নেয়। তিনি লখনৌ কিং জর্জ মেডিকেল কলেজ থেকে এমডি ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন এবং সেখানে অপারেশন ছাড়া হৃদরােগীদের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করেন। এমডি করার পর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস AIIMS এ সিনিয়র রেসিডেন্ট এবং সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ৬ বছর কাজ করেন। তিনি যােগব্যায়াম পদ্ধতির ওপরও প্রশিক্ষণ নেন। AIIMS-এ তার গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, করােনারি হার্ট ডিজিজ বা হার্ট ব্লকেজ শুধু প্রতিরােধই হয় না, তা বিলােপ করে রােগীকে নিরােগ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া আমেরিকার নন-ইনভেসিভ কার্ডিওলােজির অগ্রদূত ডা. ডিন অরনিশের নিকট প্রশিক্ষণকালেও ডা. বিমল ছাজেড় প্রমাণ করেন যে, জীবন-যাপন পদ্ধতির মাধ্যমে হৃদরােগ থেকে সুস্থতা লাভ সম্ভব। ১৯৯৫ সালে ডা. বিমল ছাজেড় AIIMS থেকে পদত্যাগ করে সাওল Science And Art Of Living-SAAOL বা আধুনিক মেশিন-মেডিসিন, আদর্শ জীবন-যাপন ও পরিকল্পিত খাদ্য-অভ্যাস সমন্বিত এক নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করে হৃদরােগীদের চিকিৎসা প্রদান শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ডা. বিমল ছাজেড় দিল্লীতে তাঁর সাওল হার্ট সেন্টার ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। পরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশসহ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানে ৩২টি শাখা স্থাপন করেন । এ সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। সাওল হার্ট সেন্টারের প্রধান কার্যালয় দক্ষিণ দিল্লির লাজপাত নগরের বিক্রম বিহারে অবস্থিত। ডা. বিমল ছাজেড় উদ্ভাবিত সাওল হার্ট প্রােগ্রাম বিনা অপারেশনে হৃদরােগ মুক্তির চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে এলােপ্যাথিক চিকিৎসার সঙ্গে চিকিৎসা-জ্ঞান, তেলছাড়া রান্না, মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা, যােগব্যায়াম ও মেডিটেশনের সম্মিলিত পদ্ধতিতে রােগীকে স্থায়ীভাবে সুস্থ করে তােলা হয়। ডা. ছাজেড় হৃদরােগীর জন্য শতাধিক বই লিখেছেন। এছাড়া ভিসিডি আকারে তার অনেক লেকচার পাওয়া যায়। তিনি প্রতিকারমূলক কার্ডিওলজির একজন চমৎকার শিক্ষক। তাঁর পরিচালনায় হৃদরােগ চিকিৎসা বিষয়ক সাওল টাইম' নামে একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ডা. বিমল ছাজেড় ৮০ হাজারেরও অধিক রােগীর চিকিৎসা করেছেন এবং হার্ট অ্যাটাক, বাইপাস সার্জারি ও এনজিওপ্লাস্টি থেকে মুক্ত থাকার জন্য রােগীদের সাহায্য করেছেন। ভারতের প্রাক্তন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রী শংকর দয়ালজী শর্মা, প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান শ্রী প্রতিভা ডি পাতিল এবং তাঁর স্বামী ডা. বিমল ছাজেড়ের কাছ থেকে সাওল চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।