"সীরাতে ইবনে কাছীর" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: সীরাতে ইবনে কাছীর ‘সীরাতে ইবনে কাছীর প্রিয় নবী হযরত মােহাম্মদ মােস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের একটি সুবিখ্যাত ও সুবিন্যস্ত জীবনী গ্রন্থ। এর মূল রচয়িতা হচ্ছেন মুসলিম ইতিহাসের জননন্দিত গ্রন্থ তাফসীর ইবনে কাছীর’-এর প্রণেতা ও সীরাত বিশেষজ্ঞ আল্লামা এমাদ উদ্দীন ইবনে কাছীর। প্রিয় নবীর প্রিয় কাহিনীর যে অচ্ছেদ্য মালা তিনি এই গ্রন্থে গেঁথেছেন, গােটা সীরাত সাহিত্যে এর নযীর মেলা ভার। বিশ্বনন্দিত ইতিহাস গ্রন্থ আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া'র পাতায় আল্লামা এমাদউদ্দীন ইবনে কাছীর যে বিশ্লেষণধর্মী দূরদৃষ্টি নিয়ে গােটা মানবজাতির ইতিহাস পর্যালােচনা করেছেন- সেই পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়েই তিনি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হযরত মােহাম্মদ (স.)-এর মহান জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, আর সেই গভীর পর্যবেক্ষণের ফলই হচ্ছে তার অমর সৃষ্টি সীরাতে ইবনে কাছীর। আল্লাহ তায়ালার নিজস্ব সাক্ষ্য মােতাবেক যে মানুষটির মাঝে তার সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে, তার পক্ষে এতােটুকু সার্টিফিকেট যােগাড় করার জন্যে আমরা অযথাই দেশ বিদেশের লেখক ও ঐতিহাসিকদের রচনা চষে বেড়াই। কোন্ আমেরিকান তাঁকে একশ’ সেরা মানুষদের শীর্ষে স্থান দিয়েছেন, কোন্ বৃটিশ লেখক তাঁর হাতে দুনিয়ার তাবৎ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তার ফিরিস্তি দিয়ে আমরা কি আসলে মানবজাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানটির ওপর ইনসাফ করছি? যারা তাঁর নামে এ বিপুল সম্মাননার স্তুতি গেয়ে বেড়ান তারা কয়জন তাদের জীবন তার আদর্শের আদলে সাজাতে চেয়েছেন? এর নির্মম জবাব হচ্ছে না, এদের একজনও চাননি। অথচ তাদের সামান্য অংশও যদি তা চাইতেন তাহলে সম্ভবত আজ এই পৃথিবীর মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মানচিত্র ভিন্নভাবে অংকিত হতাে। আজ আমরা যারা নিজেদের এই মহান মানুষটির অনুসারী বলে দাবী করি, আমরাও যেন জীবনের অন্যান্য সব কাজকর্মের মতাে সীরাত চর্চাতেও তাদের অনুকরণে মেতে উঠেছি। সীরাতুন্নবীর রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় অকেশানে সুন্দর বাণী দেয়া, বড়াে বড়াে জমকালাে অনুষ্ঠানে তার আদর্শের পক্ষে জোরালাে বক্তব্য পেশ করা ও মিডিয়ার এয়ার কন্ডিশন রুমে বসে তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প বলে দর্শক শ্রোতার বাহবা কুড়ানাে আর জীবনের খুঁটিনাটি কার্যকলাপে প্রতিনিয়ত তাকে অনুসরণ করার মাঝে মনে হয় একটা আকাশ পাতাল ফারাক আছে। এ ফারাক যতােই বাড়ছে ততােই যেন আমরা ধীরে ধীরে সমস্যার অতলান্তে ডুবে যাচ্ছি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) মদীনার রাস্তা অতিক্রম করার সময় প্রিয় নবীর উটের পা ফেলার স্থান দেখে দেখে পথ চলতেন। কেননা তিনি জানতেন, নবীর স্তুতি গেয়ে মহাকাব্য রচনা করার চাইতে নিজের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তাঁর পদাংক অনুসরণের মূল্য অনেক বেশী।
আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. এর জন্ম ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে বসরার (বর্তমান সিরিয়া) মামলুক সালতানাতে। তার পুরো নাম ইসমাঈল ইবন উমর ইবন কাসীর ইবন দূ ইবন কাসীর ইবন দিরা আল-কুরায়শী হলেও তিনি ইবনে কাছীর নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি কুরায়েশ বংশের বনী হাসালা গোত্রের সন্তান। তার জন্মস্থান এবং জন্ম তারিখ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তার শিক্ষাজীবন এবং শৈশব নিয়েও খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তবে মামলুক সালতানাতেই তিনি বড় হয়েছেন, এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত। কৈশোরে তিনি ফিরিঙ্গীদের যুদ্ধ, ক্রুসেড, তাতারদের আক্রমণ, শাসকদের অন্তর্কোন্দল, বিদ্রোহ করে ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির মতো যাবতীয় দুর্যোগ আর দুর্দশা দেখে দেখে বড় হয়েছেন। কর্মজীবনে ইবনে কাছীর রহ. উন্মুসসা’ ওয়াত তানাকুরিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। কুরআন, হাদিস, তাফসির, ইতিহাস, গণিত সহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিচরণ করেন। শায়খ তকী উদ্দী (রহঃ), উস্তাদ হাজরী (রহঃ), ইবনুল কালানসী (রহঃ) প্রমুখ প্রবাদত্যুল্য শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে নিজের জ্ঞানের আলোয় তিনি আলোকিত করেছিলেন মধ্যযুগীয় মুসলিম জ্ঞানপিপাসুদের। ১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে তার মৃত্যু হয়। আল্লামা ইব্নে কাছীর রহ. এর বই সমূহ ইসলামি দর্শন, ফিকহ শাস্ত্র, তাফসির ও ইতিহাস নির্ভর। তার রচিত ‘তাফসিরে ইবনে কাছীর’-এর জন্য তিনি বিশ্বজোড়া সমাদৃত। পবিত্র কুরআনের কাছীরগুলোর মাঝে তার এই গ্রন্থটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং প্রামাণ্য। ১১ খণ্ডে প্রকাশিত ‘তাফসিরে ইবনে কাছীর’, ‘কাসাসুল আম্বিয়া’, ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’, ‘কিতাবুল আহকাম’ সহ বেশ কিছু জ্ঞানগর্ভ বই রয়েছে আল্লামা ইবনে কাছীর রহ. এর বই সমগ্রতে।