"সংস্কৃতির বিবর্তন" ভূমিকা: সাহিত্যিক হিসাবে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, প্রথমত, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে। দ্বিতীয়ত, লোকসাহিত্যের সঙ্গে। তৃতীয়ত, ওপার বাংলার নব সাহিত্যের সঙ্গে। ওপার বাংলা বলা অবশ্য ঠিক নয়। বলা উচিত, প্রাকৃতিক বাংলাদেশের বা বঙ্গভাষী ভূভাগের বৃহত্তর অংশ। যার নাম ইদানীং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমাদের ভাবতে হবে, চেষ্টা করতে হবে, এই বিচ্ছেদ তিনটি যাতে দূর হয়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য বলতে বোঝায় রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, চৈতন্যচরিতামৃত, ফারসী থেকে ভাবানুবাদ, হিন্দী থেকে ভাবানুবাদ, এই শতাব্দীতে আবিষ্কৃত চর্যাপদ বা বৌদ্ধ সাধন পদাবলী, নাথযোগীদের সাধনগীতি, বাউলদের সাধনগীতি, মুসলমানদের পুঁথি সাহিত্য। প্রাচীন না বলে মধ্যযুগীয় বললে ঠিক হতো। ‘প্রাচীন’ শব্দটি এখানে ‘পুরাতন’ অর্থেই ব্যবহৃত অর্থাৎ যা আধুনিক নয়, যা উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর নয়। শিকড় খুঁজতে হলে আমাদের পুরাতন বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই খুঁজতে হবে। সে সাহিত্যে বৌদ্ধ, নাথযোগী, মুসলমানদেরও দান ছিল। সাধারণত আমরা এসব দানকে উপেক্ষা করি। যেন বাংলা সাহিত্য কেবলমাত্র শাক্ত ও বৈষ্ণবদেরই একার সৃষ্টি। পুরাতন সাহিত্যেও কিছু সেকুলার কাহিনী ছিল। সেগুলি আরব্য উপন্যাস বা পারস্য উপন্যাস থেকে গৃহীত। আজকালকার সাহিত্যিকরা পুরাতন সাহিত্যের সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন। ফলে একটা বিচ্ছেদ ঘটে যাচ্ছে। এই ধরুন, আমার ছেলেবেলায় আমি ‘গোলে বকাউলি’র কাহিনী শুনেছিলুম আমার ঠাকুমার মুখে। একখানা চটি বইও বোধ হয় ছিল আমাদের বাড়িতে। তা না হলে ঠাকুমা জানতেন কী করে? তারপর লোকসাহিত্যের কথা বাউল গীতিকে আমি লোকসাহিত্য বলিনে। বৈষ্ণব পদাবলীর মতো সেও সাধন মার্গের বাণী। তাকে বাদ দিলেও বিস্তর লোকগীতি আছে, লোকগাথা আছে, বচন প্রবাদ আছে, রূপকথা উপকথা আছে যা প্রধানত মুখে মুখে রচিত। মুখে মুখে প্রচারিত, সঞ্চারিত। ছাপাখানা ছিল না, তার আগে পাণ্ডুলিপিই ছিল না। মানুষের স্মৃতিই লোকসাহিত্যের কোষাগার। হাজার বছর পূর্বের কোনো ছড়া কি গান যদি এখনো লোকের মনে থাকে তবে তা বদলাতে বদলাতে বর্তমান রূপ নিয়েছে। সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এ দুটি কাজ অত্যাবশ্যক। নয়তো বিলোপ অনিবার্য ও আশু। গ্রামের লোকেরাও আজকাল সিনেমার গান, যাত্রার গান, ডিটেকটিভ কাহিনী ইত্যাদির স্রোতে মজ্জমান। লোকসাহিত্যের প্রতি সে মমতা নেই। অথচ লোকসাহিত্যের সঙ্গে জীবন্ত যোগ না থাকলে ভদ্র সাহিত্য রক্তহীন, স্বাদহীন, অগভীর হয়। সাধ্য থাকলে আমরাও লোকসাহিত্যে কিছু দান করে যেতে পারতুম। কিন্তু শহরে বসে তা সম্ভব নয় । গ্রামে একবার ঘুরে এলেও হয় না। দীর্ঘকাল বাস করতে হয় । তারপর ওপার বাংলার সঙ্গে পা মিলিয়ে নেওয়া। মন মিলিয়ে নেওয়া। ভাব বিনিময় করা পুস্তক বিনিময় করা। পত্রিকা বিনিময় করা যাওয়া আসা। মেলামেশা। দুঃখের বিষয় এর কোনো কোনোটি সহজ নয়। সরকারী বিধিনিষেধ তো আছেই, মানসিকতাও বিমুখ। লৌহ যবনিকা মাঝখানে ঝুলছে। আমি বার বার চেষ্টা করেছি, বার বার ব্যর্থ হয়েছি। আরো অনেককে চেষ্টা করতে হবে। সংস্কৃতির বিবর্তন সমস্তক্ষণ চলেছে। কোথাও তার ছেদ নেই। কিন্তু ইতিহাসে এমন এক একটা ঘটনা ঘটে যাতে এক ধারা দুই ধারা হয়ে যায়, দুই ধারার বিবর্তন স্বতন্ত্রভাবে হয়। তেমন এক ঘটনা সাতচল্লিশ সালের দেশভাগ প্রদেশভাগ। ভারতের সংস্কৃতির কথা যখন ভাবি তখন মনে থাকে না যে এখনকার বাংলাদেশও তার অঙ্গ। বাংলার সংস্কৃতির কথা যখন ভাবি তখন খেয়াল থাকে না যে অধিকাংশ বাঙালী এখন বাস করে সীমান্তরেখার ওধারে। পূর্বাপর ধারাবাহিকতা একটা আছে নিশ্চয়, কিন্তু ভারত বাংলাদেশ তথা পশ্চিমবঙ্গ পূর্ববঙ্গের ধারাবাহিকতা একই খাতে প্রবহমান নয়। কলকাতায় বসে আমি দিল্লীর সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু ঢাকার থেকে বিযুক্ত। তাই সব বাঙালীর হয়ে চিন্তা করতে বা কথা বলতে পারিনে, সব প্রাক্তন ভারতীয়ের হয়েও নয়। বিবর্তনে একটা বিচ্ছেদ থেকে যাচ্ছে, ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। এর প্রতিকার খুঁজে বার করতে হবে। ৩ জানুয়ারি ১৯৮৯ অন্নদাশঙ্কর রায়
(মার্চ ১৫, ১৯০৪ - অক্টোবর ২৮, ২০০২), একজন স্বনামধন্য বাঙালি কবি ও লেখক। ভারতের উড়িষ্যা জেলার তার জন্ম। তিনি একজন বিখ্যাত ছড়াকারও। অন্নদাশঙ্করের জন্ম হয় ব্রিটিশ ভারতে বর্তমান উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলে । তাঁর পিতা ছিলেন ঢেঙ্কানল রাজস্টেটের কর্মী নিমাইচরণ রায় এবং তাঁর মাতা ছিলেন কটকের প্রসিদ্ধ পালিত বংশের কন্যা হেমনলিনী । ছোটবেলায় ঢেঙ্কানলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন । এরপর সংবাদপত্রের সম্পাদনা শিখতে কলকাতা বসুমতী পত্রিকার সম্পাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের কাছে যান । তিনি শর্টহ্যান্ড, টাইপরাইটিং এবং প্রুফরিডিং-ও শেখেন । কিন্তু এই কাজ তাঁর ভালো লাগেনি । এরপর তিনি কটকের র্যাভেনশ কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষা দেন এবং তাতে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পরীক্ষাতেও তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম স্থানাধিকারী হন । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে এম.এ পড়তে পড়তে আই.সি.এস পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয়বারে পূর্ববর্তী রেকর্ড ভেঙে প্রথম স্থান অধিকার করেন । তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এ গৌরব লাভ করেন। সেই বছরেই তিনি সরকারি খরচে আই.সি.এস হতে ইংল্যান্ড যান । সেখানে তিনি দুই বছর ছিলেন । এই সময়ে তাঁর ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী পথে প্রবাসে বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন কন্যা অ্যালিস ভার্জিনিয়া অনফোর্ডকে বিবাহ করে তিনি তাঁর নাম দেন লীলা রায় । লীলা রায় বহু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন । অন্নদাশঙ্করের অনেক লেখা লীলাময় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম নদীয়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কাজে যোগ দেন । তিনি বছর এই পদে থেকে বিভিন্ন জেলায় কাজ করে কুমিল্লা জেলায় জজ হিসাবে নিযুক্ত হন । ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সরকারী কাজে নিযুক্ত থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিচার বিভাগের সেক্রেটারি হন । ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারী চাকরি থেকে অবসর নেন । ২৮ অক্টোবর , ২০০২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।