"হাঁসুলি বাঁকের উপকথা" বইয়ের ফ্ল্যাপের অংশ থেকে নেয়া: গ্রন্থটির নামকরণের মধ্যেই ইহার অন্তঃপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ব্যঞ্জিত হইয়াছে। ইহা ইতিহাস নহে, উপকথা। ইহার জীবনযাত্রা অতিপ্রাকৃতের ঘন-কুহেলিকা-মণ্ডিত; পৌরাণিক কল্পনা, অলৌকিক সংস্কার ও বিশ্বাস, প্রাচীন কিংবদন্তী ও আখ্যান, সদ্য অতীতের ঘটনা-প্রতিফলিত জীবনদর্শন- এ সমস্তই প্রাত্যহিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গভীরভাবে অনুপ্রবিষ্ট। হাঁসুলি বাঁকের কাহারদের জীবনদর্শন অপরিবর্তনীয়ভাবে স্থিরীকৃত- তাহাদের জীবনে যাহা-কিছু ব্যতিক্রম ও বিপর্যয়, যাহা-কিছু আকস্মিক ও অসাধারণ সবই দেবলীলা, অদৃশ্য শক্তির দুর্বোধ্য অভিপ্রায় হইতে উৎক্ষিপ্ত। সূর্যালােক ও বায়ুপ্রবাহের ন্যায় এই অলৌকিক সত্তার রশ্মিবিকিরণ তাহাদের আকাশ-বাতাসের প্রতিটি অণুপরমাণুতে পরিব্যাপ্ত। অশীতিপর বৃদ্ধা সুচাদ এই দৈবশক্তির অধিকারিণী ও ব্যাখ্যাত্রী; হাঁসুলি বাঁকের জন্মবৃত্তান্ত, উহার অতীত | কাহিনী, উহার কৈশোের ও প্রথম যৌবনের সমস্ত উদ্ভট কল্পনা ও অপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা পারলৌকিক জগৎ হইতে অভ্যাসগত প্রতিটি ধ্বনি ও স্পর্শ, দেবতার রােষ ও প্রসাদের প্রতিটি নিদর্শন তাহার স্মৃতির ঐতিহাসিক আধারে অখণ্ড সমগ্রতায় ও প্রথম অনুভূতির গাঢ় বর্ণলেপে অবিস্মরণীয়ভাবে রক্ষিত। সে এই সম্প্রদায়ের prophet বা অধ্যাত্মলােকের সহিত যােগাযােগ রক্ষার সেতু। তাহার অতীতস্মৃতিপুষ্ট, তীক্ষ্ণ অনুভূতির বেতার-যন্ত্রে দেবলােকের নিগূঢ় অভিপ্রায়, আগামী বিপদের ছায়া, বর্তমান ঘটনার তাৎপর্য সমস্তই অভ্রান্ত ভাবে লিপিবদ্ধ ও বােধগম্য হয়।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব কাটে এই বীরভূম জেলারই লাভপুর গ্রামে। ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ বাবা-মায়ের কাছে তিনিও একই সততা ও আদর্শের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করতে হয় তাঁর। মুক্তি পাওয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। তাঁর অনন্য প্রতিভায় জন্ম নিয়েছে একেকটি অসাধারণ পাঠকনন্দিত সাহিত্যকর্ম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সম্পদ। তাঁর লেখা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জীবনকে এককভাবে উপস্থাপন করে না, ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সব বৈশিষ্ট্যকে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে তিনি বাদ রাখেননি কোনো শাখা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)’, ‘পাষাণপুরী (১৯৩৩)’, ’ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)’, ’কালিন্দী (১৯৪০)’, ’কবি (১৯৪৪)’, ’হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১)’, ‘কালরাত্রি (১৯৭০)’ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের উপন্যাস সমগ্র সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৬৫টি। এর মধ্যে ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝে তিনি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী ও সাহিত্য সম্মেলন এর নেতৃত্ব দান ও সভাপতিত্ব করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবিতা সমগ্র হল ‘ত্রিপত্র (১৯২৬)। এছাড়াও সাহিত্য রচনা করেছেন ছোটগল্প, নাটক, প্রহসন ও প্রবন্ধ আকারেও। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সংকলন হলো ‘ছলনাময়ী (১৯৩৭)’, ‘রসকলি (১৯৩৯)’, ‘হারানো সুর (১৯৪৫)’, ‘কালান্তর (১৯৫৬), ‘মিছিল (১৯৬৯)’, ‘উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাস পেয়েছে চলচ্চিত্র রূপ, এদের মাঝে আছে ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘শরতস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭)’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫)’, ‘পদ্মশ্রী (১৯৬২)’, ‘পদ্মভূষণ (১৯৬৮)’ ইত্যাদি পুরস্কার ও উপাধি লাভ করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর বই সমূহ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।