‘‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান-সেনাদলের তূর্য-বাদকের একজন আমিÑএই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি জানি, এই পথ-যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে বাঁকে বাঁকে কুটিল-ফণা ভুজঙ্গ প্রখর-দর্শন শার্দূল শার্দূল পশুরাজের ভ্রুকুটি! এবং তাদের নখর-দংশনের ক্ষত আজো আমার অঙ্গে অঙ্গে। তবু ওই আমার পথ, ওই আমার গতি, ওই আমার ধ্রুব।’ কবি নজরুলকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তার প্রতিভাষণে তিনি এই যুগান্তকারী বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। তার বয়স তখন মাত্র ৩০ বছর। ওই সভায় সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বক্তব্যে নজরুলের জীবন ও সাহিত্যাদর্শ এবং যে ঐতিহাসিক কালপর্বে তিনি সাহিত্যজীবনে প্রবেশ করে বাঙালিকে আত্মমর্যাদার সাথে স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তা পরিস্ফুটিত। নজরুলের অভিভাষণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তামান্না আনওয়ার তার ‘নজরুল ও অন্যান্য ভাবনা’ গ্রন্থে এ মন্তব্যটি তুলে ধরেন। তার এ গ্রন্থে ‘নজরুলের অভিভাষণ প্রসঙ্গে’ নিবন্ধটিতে তিনি নজরুলের অভিভাষণ ও প্রতিভাষণের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। তার গ্রন্থটিতে নজরুল সম্পর্কে আরো দুটি নিবন্ধ ‘নজরুলের শিশুসাহিত্য’ ও ‘নজরুল-কবিতায় নারী : বিষয় ও আঙ্গিক’ রয়েছে। ‘নজরুলের শিশুসাহিত্য’ নিবন্ধটিতে তিনি নজরুলের শিশুসাহিত্যবিষয়ক রচনাগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার পর বেশ কিছু কবিতার ওপর অলোচনা করেছেন। নজরুলের ‘নতুন পথিক’ কবিতাটির আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘শিশুরা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালোবাসে। নিজেদের মৌলিক প্রবণতাগুলো অন্য আরেকটি শিশুর মধ্যে দেখলে তার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে।’ কবি নজরুল কবিতাটিতে বলেছেন, ‘নতুন দিনের মানুষ তোরা আয় শিশুরা আয়!/ নতুন চোখে নতুন লোকের নতুন ভরসায়।’ শিল্পী নজরুল শিশুদের মনের গহিনের স্বপ্নকে নতুন দিনের নতুন শিশুদের মানসলোকে প্রতিভাত করেছেন। নিষ্কলঙ্ক শিশুদের হৃদয়ে যেন আগামীর নতুন পৃথিবী স্বর্গরূপে রচিত হয়Ñকবি এ কামনা করেছেন। নজরুলের শিশুসাহিত্যগুলোর ওপর নিবন্ধটিতে তামান্না আনওয়ার বিশ্লেষণী মন্তব্য তুলে ধরেছেন। গ্রন্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘নজরুল কবিতায় নারী : বিষয় ও আঙ্গিক’-এ গ্রন্থকার নজরুলের কবিতায় নারী কীভাবে চিত্রিত হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় রামমোহন-বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে নারী কীভাবে নিষ্পেষণের নিগূঢ় ভেঙে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং নজরুল সেই নারীকে কতটা নিপুণভাবে তার কবিতায় তুলে ধরেছেন তারই চিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ধর্ম ও নীতির দোহাই দিয়ে অসহায় পশুর মতো নারীকে বন্দি করে যে অসম্মানজনক ও বিভীষিকাময় জীবনপ্রবাহ চলছিল সেখানে কবি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন মুক্তির বাণী।’ নজরুল যে নারীকে সম-অধিকারের আসনে পুরুষের পাশাপাশি, শক্তির উৎস ও কর্মঠ হিসেবে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটির অন্যান্য নিবন্ধগুলো ‘সমাজসংস্কারকদের দৃষ্টিতে নারী’, ‘নারী নির্যাতন যুগে যুগে’ এবং ‘নজরুল-গ্রন্থাগার ও জাদুঘর’। নজরুল ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরির দায়িত্বে কর্মরত থাকার কারণে গ্রন্থকার নজরুল-গ্রন্থাগার ও জাদুঘর সম্পর্কে যে তথ্যবহুল নিবন্ধটি উপরি পাওয়া হিসেবে এতে সংযোজন করেছেন তা পাঠককে বেশ কিছু নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে।