''১৯৭১ ও অনেক অজনা কথা'' বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপ এর লেখা : রক্তে রাঙা ১৯৭১। অক্রর আলপনা আঁকা ১৯৭১। অপরিমেয় কষ্ট ত্যাগ আর সাহসের পরীক্ষার উত্তীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা ওড়ানোর ১৯৭১। এই ১৯৭১ সালে বছরের এক দৃঢ়প্রত্যয়ী তরুণ আবু মোহাম্মদ খান (বাবলু) অনেক কষ্টে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিলেন ভারতে। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত মূর্তি পাহাড়ের মুজিব ক্যাম্পে নিয়েছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণ। যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে অস্ত্র হতে নেমে এসেছিলেন রণাঙ্গনে। মাসের পর মাস যুদ্ধ করেছিলেন একনাগাড়ে, এবং যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। অস্ত্রের গর্জনের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখেছিলেন ১৯৭১-কে, দেখেছিলেন জীবনবাজী রাখা যুদ্ধের ভিতর দিয়ে। এক কোটি শরনার্থীর দুঃসহ অমানবিক জীবনকেও তিনি দেখেছিলেন কাছ থেকে। আবার দেশের অভ্যন্তরে চরম অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তার মধ্যে বসবাসকারী মানুষের বেদনাকেও স্পর্শ করেছিলেন হৃদয় দিয়ে। সিরাজগঞ্জ জেলার তামাই হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন রাজনীতির সঙ্গে । ১৯৬৯ সালের ছাত্র- গণআন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। যুদ্ধশেষে স্বাধীন স্বদেশে সেই রাজনীতির আঙিনা ছেড়ে তিনি দূরে সরে যাননি। পথ চলেছেন তারই ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সেই কিশোর বেলায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এবং যমুনা নদী অতিক্রম করে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। এই বর্ষীয়ান নেতার বড়ত্ব দেখে তিনি যুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়েছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী শক্তি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলেন একটা চুম্বকের মতো। তাই কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আকৃষ্ট করেছিলেন তাঁর মনোযোগ এবং অর্জন করেছিলেন তাঁর স্নেহ ও আস্থা। পরিচিতি হয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ. এইচ. এম কামরুজ্জামানের সঙ্গে। মুগ্ধ হয়েছেন তাঁদের ক্রিয়াকর্মে ও চারিত্রিক গুণকীর্তিতে, শোকে দগ্ধ হয়েছেন তাঁদের আকস্মিক ও অপঘাত-মৃত্যুতে। কিন্তু বিচ্যুত হননি আপন কর্তব্যবোধ থেকে। ঢাকা শহরে মাইকিং করে প্রতিবাদ সভার আহবান জানিয়েছেন এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও মনসুর আলীর মরদেহ নিজ হাতে শুইয়ে দিয়েছেন বনানীর গোরস্থানে। ঢাকা কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছেন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হিসেবে, তাই সাহিত্যের সঙ্গেও গড়ে উঠেছে তাঁর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আবু মোহাম্মদ খান (বাবলুর শুধু সাহিত্যের সঙ্গে নয়, সাহিত্যকর্মার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক নিবিড়। দুই বাংলার সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ও পত্রালাপের ভাষা যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি মনকাড়া বিশেষ করে অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ ও সাহিত্যিক চানক্য সেনকে লেখা তাঁর চিঠি এবং তাঁকে লেখা গীতা রায়ের চিঠিগুলো তো বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। পাশাপাশি তাঁর প্রতিবাদের ভাষা অগ্নিস্পর্শী, যাকে তিনি অন্যায় কিংবা অশোভন মনে করেছেন, তারই প্রতিবাদ করেছেন তেজস্বী ভাষায়। তসলিমা নাসরীন প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায়কে লেখা চিঠি কিংবা 'চিলেকোঠার সেপাই' সম্পর্কে উচ্চারিত অন্যায় মন্তব্যের প্রতিবাদে আমরা তাঁরা সেই তেজস্বীতাকে দীপ্যমান হতে দেখি। আবার যৌক্তিক ও মানবিক বোধের দ্বৈত আলো ছড়িয়ে ২০০৭ সনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের কাছে লেখা 'শেখ হাসিনাকে দুঃখ দিয়ে নিজ সুখ নিও না, সত্য ও ন্যায় ধর্মকে করো না বিমুখ তব প্রাসাদ হতে শিরোনামভুক্ত চিঠিটি পড়লে বোঝা যায় দুর্গত কিংবা বিপদগ্রস্ত শেখ হাসিনার পাশে কী প্রচণ্ড আকুলতা নিয়ে তিনি ঋজু হয়ে দাঁড়াতে পারেন। আবার ভেজালমুক্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা কত তীব্র এবং আকুলতা কত নিবিড়, তা বোঝা যায় যখন দেখি এ সম্পর্কিত একটি বলিষ্ট যুক্তি ও তথ্যবহুল লেখা নিয়ে দিনের পর দিন তিনি তা ছাপানোর জন্য পত্রিকা সম্পাদকের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরেন। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আবু মোহাম্মদ খান (বাবলু) পথ হেঁটেছেন । যুক্ত হয়েছেন নানাবিধ সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে । জাতীয় জীবনের অনেক অজানা তথ্য তাঁর প্রসারিত করতল স্পর্শ করে আছে এবং এসব কিছুরই সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে এই ‘১৯৭১ ও অনেক অজানা কথা' গ্রন্থটিতে, আর সে প্রকাশের ভাষা যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি গতিশীল, প্রাণবন্ত ও হৃদয় গ্রাহী। -সরদার আব্দুস সাত্তার ০৫-০৩-২০১০