"তলস্তয়" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: রচনায় কোন গুণ থাকলে সে রচনা তার কালের সীমা ছাড়িয়ে, স্বদেশের বেড়া ডিঙিয়ে সব দেশের সব কালের প্রিয় বস্তু হয়ে ওঠে? কেনই বা পৃথিবীর গ্রন্থাগারগুলির সেলফ তলস্তয়ের রচনায় ভরে উঠেছে? তাঁর রচনাবলীকে কেনই বা লােকে ঘরের অনশ্বর আসবাব মনে করে? তিনি কেমন করেই বা আমাদের মনেরও অপরিত্যাজ্য আসবাব হয়ে উঠেছেন ? তলস্তয় সম্পর্কে এ সমস্ত প্রশ্নই আমাকে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়—কোন্ যােগ্যতার জোরে প্রাইজ না-পাওয়া রুশ লেখক তলস্তয় প্রাইজ পাওয়াদের পেরিয়ে এলেন, একশ একান্ন বছর পরেও আমাদের এই কালে নানা লজ্জায় লবেজান ভারতেরও প্রিয় কথাশিল্পী হলেন? তলস্তয় কী লিখেছিলেন যা আমাদের এ কালেরও প্রিয় বিষয়? একটু তলিয়ে দেখার দরকার বই কি! তার আগে কলকাতার বস্তিগুলির দিকে একবার তাকান-জঞ্জালের উঁইয়ের পাশে খােলা নর্দমার উপচে পড়া জলের ধারে থিকথিকে কাদা, পােকা, মাকড়, ইঁদুর, আরশােলা এবং সহস্র প্রকার ব্যাধির বীজাণুর সঙ্গে বাস করছে যারা, তাদের বেঁচে থাকার লড়াইটা একবার দেখে আসুন। নিরাশ্রম নিরন্ন নির্বাস ফুটপাথের মানুষগুলিকে একবার দেখুন—ঠিক ওই রকম ছিল তলস্তয়ের সময়কার মস্কোয়া আর পিতার্সবুর্গ শহর। উভয় শহরই কলকাতার মতন প্রাসাদ-নগরী; জারের ও জারের ভুক্তাবশেষভােগীদের প্রাসাদগুলি ছিল সব থেকে জাঁকালাে গম্ভীর ও সুদর্শন—সে কালের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌধকারদের উৎকৃষ্ট রচনা। এই প্রাসাদনগরীতে থাকতেন অ্যারিস্টোক্র্যাটরা। ক্রীতদাসদের হাড়-ভাঙা পরিশ্রমের সম্পদ মুঠোয় মুঠোয় যারা মদ মেয়েমানুষ আর জুয়া নিয়ে ফুর্তিফার্তা করে উড়িয়ে দেয় আবীরগুলাবের মতন। তারপর আসুন পল্লীগ্রামে, ভূমিদাস বর্গাদার জোতদার ভূস্বামী—উপবাসী অর্ধউপবাসী থেকে প্রাচুর্যের পরমান্নভােজী মানুষদের দেখুন, নানা শ্রেণীতে নানা ধর্মে নানা বিচিত্র সংস্কারে ছিন্ন বিভক্ত একটা জাতির কথা ভাবুন, তা হলেই তলস্তয়ের কাল-সেকালের সমাজ রাষ্ট্র, তার শশাষণ শাসন ও জীবনযাপন বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন কি সমাজে ও সময়ে তলস্তয় জন্মেছিলেন। ওহ, সেদিনের রুশ-সংস্কৃতির কথা বলা হয়নি বুঝি। তাহলে একটা জ্বলন্ত হ্যাজাকের কথা ভাবুন। তে-কাঠেতে উঁচু করে একটা জ্বলন্ত হ্যাজাক যদি ঝুলিয়ে রাখেন দেখবেন তার তলায় একটা গাঢ় অন্ধকারের বৃত্ত, তারপর অনতিদূর অবধি একটা চোখধাঁধানাে আলাের রােশনাই, তারপর আবার গাঢ় অন্ধকার। শহরের দরিদ্র অঞ্চলটা হচ্ছে আলাের তলাকার সেই অন্ধকার আর আলােকিত বৃত্তটা জারের অনুগ্রহ পুষ্ট ও তার শাসন-শােষণের হাতিয়ার—খিদমদগার, শিক্ষিত ও সুখাদ্যপুষ্ট বিলাসী সমাজ। তারপর সমগ্র জার সাম্রাজ্যব্যাপী ঘােরতর তমসা—সেখানে বাস করে অশিক্ষিত নিরন্ন রুগ্ন গােটা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ, ভেড়া আর ঘােড়ার চেয়েও যাদের দাম কম, খাটুনি বেশি। শােনা যায় তাদেরই কয়েক কোটির হাড়গােড়ে বালতিক সাগরের মােহনায় জলা-জমি, মজা-নদী-বিল ভরাট হয়ে চাদার অফ রুশ সী পাওয়ার পিতর দ্য গ্রেটের বিলাসপুরী পিতবৃর্গ গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে এই নিপীড়িত নবীচিদেরই সর্বপ্রকারে বতি ক্ষুদ্ধ জীবনের দুঃখ দৈন্য সুখ অসুখ নিয়ে তৈরি হয়েছিল মনীষী তলস্তয়ের “মিরার অব রুশ রিভল্যুশন”। প্রবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের সংগ্রামের হাতিয়ার অহিংস অসহযােগ ও আত্মশুদ্ধির যে আন্দোলনে আসমুদ্রহিমাচল উদ্বেল হয়ে উঠেছিল, টলমল করে উঠেছিল ভারতে বিদেশী শাসকের আসন তারও মন্ত্রস্রষ্টা ঋষি এই তলস্তয়। বিশ্ব-সাহিত্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র ‘মুঝিক’ [মুঝিক (রুশ শব্দ) মানে—কৃষক] কথাশিল্পী। সাহিত্যে সত্যিকারের একজন মুঝিক’ তার পরে আজও বিশ্ব-সাহিত্যে দ্বিতীয় কেউ আসেননি। এমন একজন সাংঘাতিক’ মানুষকে পুরস্কৃত করে নিখিল বিশ্বের বিশেষ কৌতুহলের পাত্র এবং মনােযােগের বিষয় করে তুলতে—তার বাইবেল ও গির্জা-বিরােধী, শােষণ-বিরােধী মানবতাবাদী মতবাদকে স্বীকৃতি দিতে সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের ধ্বজাধারী নােবেল কমিটি যে চরম ভয়ে চোখ বুজে থাকবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু তারা যদি কিঞিৎ সাহস করে চোখ খুলে তাকাতেন তাে দেখতে পেতেন আসলে তলস্তয় সহাবস্থানেরই প্রবক্তা, বিপ্লব বা শ্ৰেণী-সমাজ ভাঙার উস্কানিদাতা নন। অর্থাৎ তিনি তাদেরই লােক। তাই যদি সত্যি তাে লেনিন কেন তলস্তয়ের রচনাকে বললেন—এ মিরার অব রুশ রিভুলিয়ুশন’? কেননা, সে কথাও মিথ্যে নয়। অর্থাৎ তলস্তয় ছিলেন নানা বিপরীতের বিরােধে জেরবার আত্মদ্বন্দ্বে অস্থির উনিশ শতকের রাশিয়ার সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীদের বিভ্রান্ত অংশের প্রতিনিধি। লেনিনের কথা উদ্ধৃত করে রুশ লেখক প্রেত্রোসিয়ান বলেছেন—The contradictions in Tolstoy's views are not contradictions inherent in his personal views alone, সে-গুলি বিপরীতের সংঘাতে সংকটাপন্ন সামাজিক প্রভাবের পরিণাম যার একটা সমাধান খুঁজছিলেন যাঁর যাঁর মতন করে তখনকার রুশ বুদ্ধিজীবীরা। তলস্তয় তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির মধ্যে, জৈবিক ধর্ম ও নীতি ধর্মের মধ্যে, ভূমিদাস ও ভূম্যধিকারীর মধ্যে জটিল দ্বন্দ্ব বিরােধের একটা সমন্বয় সূত্র আবিষ্কারের সন্ধানে সারাজীবন যন্ত্রণায় জ্বলেছেন। এই ভাবে জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে পুড়তে তিনি ছাই না হয়ে কি ভাবে সােনা হয়ে উঠলেন, সৃষ্টি করলেন নিজের অভিজ্ঞতার মিনার-যুদ্ধ ও শান্তি, আন্না কারেনিনা, পুনর্জীবন, স্বীকারােক্তি, ইভান ইলিচের মৃত্যু, শিল্প কী ইত্যাদি ইত্যাদি বিশ্বসাহিত্যের অমর চিন্তা-সম্পদ—আমার এই রচনা সেই অন্বেষণেরই ফলশ্রুতি।