প্রকাশিত গ্রন্থ হিসেবে দ্বিতীয় হলেও ‘গলে পড়ে জোছনা’ সুমন হুসাইনের প্রথম উপন্যাস । এবং তার লেখা বেশ পক্ক এবং ঈর্ষান্তিতভাবে উন্নত । লেখার মধ্যে আলাদা ধরণের একটা সৌন্দর্য্য আছে । বড় বড় লাইনের বাক্যগুলো সাবলীল আর প্রাঞ্জল, হলুদ ঢোঁড়া সাপের মত স্লিম এবং সুন্দর । নায়িকা প্রধান এ উপন্যাসের নায়িকা মিথিলা, আর নায়ক মুনিম । বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই মুনিম বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত এবং নাস্তিক । অপর দিকে মিথিলা পুরোপুরি আস্তিক, কিন্তু এই ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব হয় না । বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে মুনিমের কণ্ঠে ফোটে প্রতিবাদের খই, জীবনের ভয় না করে সব সময় পাশে থেকেছে বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের । আর সেটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করে হাতে পায়ে গুলি করে । মুনিমের দুটো হাতই কেটে ফেলতে হয় । তারপরও মিথিলা তাকে ছেড়ে যায় না, পরম ভালোবাসায় আগলে রাখে নিজের এত সংগ্রামভরা দিনগুলোর মধ্যেও । পুলিশের অত্যাচারের বলি হয়ে একদিন মুনিম মারা যায় । মিথিলা মুনিমের রোপিত গর্ভের সন্তান আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে চায় । কঠিন থেকে কঠিনতর হয় ওর দিনগুলো । এভাবে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যায় মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাঃ মিথিলা । সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আমাদের দেশে প্রচুর লেখা হয় কিন্তু সেটা কতটা সাহিত্য মান বজায় রাখতে পারে সেটা প্রশ্ন থেকেই যায় । এদিক দিয়ে সুমন হুসাইন খুব ভালোভাবেই সফল ।
আস্তিকতা নাস্তিকতার দ্বন্দ, মানব মনের দ্বন্দ, দ্রোহ ও প্রেম, সমসাময়িক রাজনীতির বেহাল দশা , বাম রাজনীতি, দারিদ্রের কষাঘাতে মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রাম, মেডিকেলের প্রতিদিনকার জীবনগাঁথা , প্রশ্নফাঁসবিরোধী আন্দোলন, প্রতিকূল সমাজব্যবস্থার মধ্যেও নারীর সংগ্রাম - সবগুলো বিষয় চলে এসেছে একটা লেখায় । অথচ, উপন্যাসের বর্ণনায় কোনো জড়তা নেই , পুরো উপন্যাস একটা টানটান ভাব ধরে রেখেছেন লেখক । পড়তে গেলে একটুও ক্লান্তি আসে না । এটা যে তার প্রথম উপন্যাস সেটা কোনো পাঠকেরই আঁচ করতে পারা তো দূরের কথা হয়তো তারা আরো উপন্যাস খুঁজবে এই লেখকের ।
মেধাবী অনুজ প্রতীম সুমন হুসাইন নামের এই উপন্যাসিক সত্যিই সাহিত্য অন্তঃপ্রাণ । যার চিন্তা চেতনার নিরীক্ষাধর্মী বিশ্বাসে বেঁচে থাকুক বিপ্লব, তৈরী থাকুক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, ভালো থাকুক দেশের মানুষ ।
লেখক পরিচিতিঃ ছোট গল্পকার ও উপন্যাসিক সুমন হুসাইনের জন্ম ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ, রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি থানার জামসাপুর গ্রামে । শৈশব, কৈশোরের পুরোটা সময়ই কেটেছে গড়াই পাড়ের ছোট্ট সুন্দর ছবির মতো গ্রামটিতে, খুবই দুরন্তপনায় । মাধ্যমিক পড়াশোনা লিয়াকত আলী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে, তারপর ঢাকার স্বনামধন্য নটরডেম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনার পাঠ শেষ করেন কৃতিত্বের সাথে । নরডেম রাইটার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং নটরডেম ইংলিশ ক্লাবের সহ - সভাপতিও ছিলেন ।
ছোটবেলা থেকেই শুধু লেখাপড়া নয়, যুক্ত আছেন পাঠ্যবই বহির্ভূত অনেক সৃষ্টিশীল কাজের সাথেও । ছিলেন স্টেজ কাঁপানো বিতার্কিক । পাশাপাশি অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পথশিশুদের জন্য কাজ করছেন ইচ্ছেকুঁড়ি নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে, যার স্বপ্ন কারিগর লেখক নিজেই । শুধু কলমযোদ্ধা নন, বাস্তবেও তিনি পরিবর্তনকামী একজন নির্ভীক যোদ্ধা । সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া মেডিকেলের ক্যারি অন আন্দোলন ও প্রশ্নফাঁসবিরোধী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সমন্বয়ক ছিলেন তিনি ।
বয়স খুব বেশি না হলেও তার জীবনটা অনেক বৈচিত্র্যে ভরপুর, অনেক টানাপোড়ন আর সংগ্রামের মাধ্যমে বড় হয়ে উঠা তার । এগুলোই তার লেখালেখির রসদ । তার লেখার প্রধান বৈশিষ্ঠ্য বাস্তবধর্মীতা, আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই তার সুচিন্তিত লেখনীতে পায় অনন্য গল্পরূপ । লেখকের প্রতিটা লেখায় উঠে এসেছে তার বর্ণিল শৈশব , নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সংগ্রাম , গ্রামীণ জীবন, নারীর অধিকার, অসহায় এবং সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনগাঁথা আর একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার একরাশ স্বপ্ন ।