নিজেকে ‘রবি বাউল’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আসলে বাংলার অনেক কবির বুকেই বাস করে এক বাউল। একতারা হাতে সে ঘুরে বেড়ায় নিরুদ্দেশের পথে । মনের ভেতর সে খোঁজে এক মনের মানুষ, সে মনােবেড়ি পরাতে চায় অচিন পাখির পায়ে। তােমায় মনে পড়ে’, ‘অভিমান’ ও ‘নন্দিত নীলিমা’র পর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘উৎপল দুটি হাত’-এ এসে কবি জেবু নজরুল ইসলাম প্রমাণ করেছেন তিনি সত্যই এক জীবন বাউল। প্রাণের গভীর সব কথা তিনি বলতে চেয়েছেন প্রাণের সহজ ভাষায়। প্রার্থনায় উথিত তার হৃদয় পৃথিবীতে অপার্থিব, প্রকৃতিতে অপ্রাকৃত রূপচেতনায় সমর্পিত, প্রাপ্তি তার বেদনা-সুন্দর মহিমায় বিষাদ-মধুর। তাঁর কবিতার ‘তুমি’কে তাই যেন মনে হয় দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সােনা’। একই সুর কবি বাউল জেবু’র উচ্চারণে: “... আমার কল্পনাও তুমি, আমার স্বপ্নও তুমি | তুমি আমার বুকের অনন্ত তৃষ্ণা, অহােরাত্রি তােমাকে বুকের গােপন গভীরে ধরে রাখি, তবুও কেন দূরে থেকে শুধু | মায়া বাড়াও, তুমি কি কেবলি বনের পাখি?...” এ এক পরম পিপাসা। কিন্তু এ পিপাসা কি মেটে? নাকি শূন্যতার বুকে কেবলই হাহাকার তুলে গভীর আর্তিতে বারবার লুটিয়ে পড়াই সার? হয়তাে তাই, তবুও কোনও তীব্রতায় বিদীর্ণ নন জেবু নজরুল ইসলাম। না পাওয়াকেও তিনি বরণ করে নেন শান্ত আবেশে, স্বীকার করে নেন। জীবনের অনেক অপ্রাপ্তিকে সহজ স্বাভাবিকতায়। তখন কাব্যিক উচ্চারণ তাঁর সত্যিই প্রশান্ত সুন্দর: ... দেখা হলাে না দুজনে বসে কার্তিকের অসীমাকাশে মণিদীপ্ত আলােক মুকুর, দেখা হলাে না শুভ্র পুঞ্জ মেঘের খেলা, হলাে না দেখা কিভাবে | হয় হেমন্তের সন্ধ্যা প্রশান্ত মধুর।” ‘উৎপল দুটি হাত’ কবি জেবু নজরুল ইসলামের প্রতিদিনের প্রগাঢ় অনুভবে নিমগ্ন অন্বেষণের সৃষ্টি। এর অবয়বে দেখি অতৃপ্ত স্বপ্নসমূহের সঞ্চরণ-দৃশ্য, দেখি মধ্যরাতের কুহেলি, নিঝুম আবেশ। কবি তবু অধীর, উদাস। তাঁর জীবন নায়িকা কবিতায় ছড়িয়ে যায় মুগ্ধ সুরভি, সে মায়াবী নারীর অধরের ভাঁজে ফুটে ওঠা হাসি আজ স্মৃতিসুখ শুধু। তাই এ কাব্যগ্রন্থে সঙ্কলিত ৫৮টি কবিতায় এক মরমী মানুষের তৃষিত বুকের যে। অনন্ত হাহাকার শুনি তা স্বতােৎসারিত, প্রাণময়, হৃদয়স্পর্শী। সাযযাদ কাদির, কবি ও বহুমাত্রিক লেখক সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট