জীবন শুধু যাপনের নয়, উদযাপনেরও এই বইটি হওয়ার কথা ছিল না, অন্তত আমার পরিকল্পনায় ছিল না। প্রকাশক যখন আমাকে ফোন করে পাণ্ডুলিপি চাইলেন, স্বভাববিরুদ্ধভাবে আমি মুখের ওপর না করে দিয়েছি। না করার কারণ, আমার কাছে কোনো পাণ্ডুলিপি নেই। আর আগে থেকেই পরিকল্পনা করা বই গোছাতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে নতুন করে ভাবার সুযোগই ছিল না। অপরিচিত প্রকাশককে না করলেও আমি একটু বিস্মিত হয়েছি, আমার মতো অচল লেখকের কাছে পাণ্ডুলিপি চায়, এমন বোকা প্রকাশকও বাংলাদেশে আছেন! মুখে না বললেও মনের ভেতরে নিশ্চয়ই ‘হ্যাঁ’ ছিল। তাই অন্য পাণ্ডুলিপি গোছাতে গোছাতে মনে মনে ভাবছিলাম। পাণ্ডুলিপি গোছাতে গিয়ে দেখি হিমশিম অবস্থা। সারা বছর এত আজেবাজে লেখা লিখেছি, এখন কোনটা রেখে কোনটা ফেলি অবস্থা। বাছতে বাছতেই দেখি খেলাধুলা নিয়ে বেশ কিছু লেখা হয়ে গেছে। এগুলো আলাদা করলে কেমন হয়, এমন ভাবতেই ভাবতেই বাংলাট্রিবিউনের শেরিফের ফোন। এবার আর না করা গেল না। এই হলো এই বইয়ের ইতিহাস। পাণ্ডুলিপি গোছাতে পড়তে গিয়ে দেখি ছেলেবেলা থেকে খেলাধুলার প্রতি যে গভীর মমতা, তার একটা প্রকাশ হয়ে যাবে এ বইয়ে।
খেলাধুলাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? মানুষের শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য খেলা দরকার, এটা তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু মানি না। আমাদের অভিভাবকরা খেলাধুলাকে মনে করেন সময় নষ্ট। বাংলাদেশের অনেক তারকা ক্রিকেটার ছেলেবেলায় খেলার জন্য বাবা-মায়ের অনেক মার খেয়েছেন। অনেকের ব্যাট কেটে ফেলা হয়েছে। আবার সাকিব আল হাসান এক লাখ ডলারে পাকিস্তানে খেলতে যাচ্ছেন, এটা শুনে আমার এক সহকর্মী বললেন, তার ছেলেকে লেখাপড়া না করিয়ে শুধু ক্রিকেট খেলাবেন। শুনে আমার ভালো লাগেনি। কারণ তার আগ্রহে ক্রিকেটের প্রতি বা খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা ছিল না, ছিল ডলারের প্রতি লোভ। আমি বিশ্বাস করি না, সারা দিন ব্যাট-বল নিয়ে পড়ে থাকলেই কাউকে ডলার কামানো সাকিব আল হাসান বানানো সম্ভব। সাকিব আল হাসানরা জন্মায় প্রতিভা নিয়ে তাদের বানানো যায় না। পরে প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশে, অভিভাবক বা কোচ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু প্রতিভা নেই, ভালোবাসা নেই; খালি প্র্যাকটিস করেই ভালো ক্রিকেটার বনে গেছেন, এমন ইতিহাস নেই। প্রতিভার কথাই যখন এল, তখন শচীন টেন্ডুলকার আর বিনোদ কাম্বলির গল্পটা বলে নিই। ১৯৮৮ সালে হ্যারিস শিল্ডে সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরের হয়ে শচীন আর বিনোদ জুটি করেছিলেন ৬৬৪ রান। যেকোনো জুটিতে সেই বিশ্বরেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ন আছে। তখন ওই দুই প্রতিভাবান স্কুলবালককে নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। বলাবলি হচ্ছিল, এই দুজনের মধ্যে বিনোদ কাম্বলি বেশি প্রতিভাবান ছিলেন। সেই প্রতিভার ছিটেফোটা ক্রিকেটবিশ্ব দেখেছে বটে, তবে বিনোদ কাম্বলির খ্যাতি ক্রিকেটের কারণে নয়, কুখ্যাতি প্রতিভার অপচয়ের উদাহরণ হিসেবে। আর শচীন খেলাটির প্রতি ভালোবাসা, একাগ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে নিজেকে পরিণত করেছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। আমি বারবার শচীনকে দেখি আর শিখি, সবাইকে শিখতে বলি। গোটা ক্যারিয়ারে প্রচারের আলোয় থাকলেও কোনো বিতর্ক নেই। যত বড়, তত বিনয়ী; এই আপ্তবাক্য সত্য মনে হয় শচীনকে দেখলে। ক্রীড়া তারকারা তরুণদের আইডল হন, তবে সবাই নয়। শচীন যেমন সত্যিকারের আইডল, কিন্তু ম্যারাডোনা নন। ক্রীড়া তারকাদের কাছে মানুষ পরিচ্ছন্ন ইমেজ চায়, চায় তার মতো হতে। কিন্তু ম্যারাডোনা যত বড় তারকাই হন, যত ভালো ফুটবলই খেলুন; কোনো অভিভাবকই চাইবেন না তার সন্তান ম্যারাডোনার মতো হোক। এই যেমন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব। কিন্তু তিনি আইডল নন, আইডল হবেন মাশরাফি। আশরাফুলও আইডল হবেন না।
সন্তানের হাত থেকে ব্যাট কেড়ে নেওয়াও যেমন ঠিক নয়। আবার টাকা কামানোর মেশিন বানাতে সব ছেড়ে সারা দিন ক্রিকেটে ফেলে রাখাটাও ঠিক নয়। বাংলাদেশে ক্রিকেটে গ্ল্যামার, অর্থের ঝনঝনানি দেখে অভিভাবকরা সন্তানদের সাকিব-মাশরাফি বানাতে ব্যাকুল হয়ে যান। কিন্তু সবাই সাকিব-মাশরাফি হবেন না। সবাই ক্রিকেটারাও হবেন না। শুধু যে সাকিব বা মাশরাফি হওয়ার জন্যই খেলতে হবে, তা নয়। খেলাটা হতে হবে আনন্দের জন্য, চিত্তের তৃপ্তির জন্য, সুস্থ থাকার জন্য। বিষয়টা হলো, যার কাছে যেটা ভালো লাগে। কারও ভালো লাগবে কুস্তি, কারও কাবাডি, কারও ফুটবল, কারও বা ক্রিকেট। আনন্দটাই যেন মুখ্য হয়, অর্থটা নয়। কিন্তু ইদানিং সারা বিশ্বেই পাল্টে গেছে চক্র। খেলা মানেই টাকা; আবেগ পরে, আগে টাকা। এই যেমন এখন পাকিস্তানের আচরণ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবাদে উত্তাল। দাবি উঠেছে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার। কিন্তু টাকার লোভে সাকিবরা ঠিকই খেলতে যাচ্ছেন পাকিস্তান ক্রিকেট লিগে। আগে খেলোয়াড়দের সঙ্গে ক্লাবের নাম মিলেমিশে যেত। কাজী সালাউদ্দিন মানেই আবাহনী, সালাম মুর্শেদী মানেই মোহামেডান। কিন্তু এখন কথা দেওয়ার পরও বাড়তি টাকা পেলে ক্লাব বদলে ফেলার ঘটনা অহরহই ঘটে। পেশাদারিত্বের দোহাই দিয়ে সবাই আবেগটাকে দূরে রাখেন। অথচ আমার কাছে খেলাধুলায় আবেগটাই মুখ্য। আমি একটু পুরোনো ঘরানার— ফুটবলে জয়ের চেয়ে শৈল্পিক সৌন্দর্য বেশি চাই, ধুমধারাক্কা টি-২০’র চেয়ে অলস টেস্টই মন কাড়ে বেশি। খেলা আমার কাছে নিছক খেলা নয়, জীবনাচরণ। খেলাধুলা থেকে আমি জীবনের শিক্ষা নিই। সব সময় হয়তো পারি না, কিন্তু আমি সবকিছু স্পোর্টিংলি নেওয়ার চেষ্টা করি। সবকিছুতে সিরিয়াস হয়ে বেঁচে থাকার আনন্দটা মাটি করতে চাই না। কিন্তু ইদানিং অন্য সব ক্ষেত্রে তো বটেই, স্পোর্টসেই স্পোর্টিং স্পিরিটের বড় ঘাটতি। তবু আমি জানি খেলাধুলাতেই সব আনন্দ। আমরা যদি লোভের গরলটুকু ছেকে ফেলে স্পোর্টসের আনন্দটুকু নিতে পারি, বেঁচে থাকার মানেই বদলে যেতে পারে। তাই বইয়ের নাম ‘স্পোর্টিংলি নাও’। জীবন একটাই, জীবন অমূল্য। জীবন শুধু যাপন করার জন্য নয়, উদযাপনেরও। আর এই উদযাপনের রসদ আমি পাই খেলাধূলা থেকে।
বইয়ের পাণ্ডুলিপি গোছাতে গিয়ে একটা তৃপ্তি পেলাম। গত বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট যে স্বপ্নের সময় পার করছে, তার একটা ধারাবিবরণীর মত আছে এতে। মাশরাফির নেতৃত্বে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের পাশে কলম হাতে আমিও ছিলাম ভেবে ভালো লাগছে। আজ গোটা বাংলাদেশ মাশরাফি-জাদুতে বুঁদ। ভালো লাগছে, মাশরাফিতে আমি বুঁদ আরও অনেক আগে থেকেই।
যত দিন ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেছি, মনের আনন্দেই করেছি। তখনই শুনেছি, এখনো শুনি, অনেকেই নাকি ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতে আসেনই বিদেশে পাড়ি জমাতে। বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্ট কাভার করতে গিয়ে ফিরে না আসা ক্রীড়া সাংবাদিকদের তালিকা কম লম্বা নয়। আমি যখন ক্রীড়া সাংবাদিকতা ছেড়ে দিই, তখনো আমাকে আটকানোর জন্য লোভ দেখানো হয়েছে, আরে মিয়া, থাকো। স্পোর্টসে থাকলে দেশ-বিদেশে ঘুরতে পারবা। সুযোগমতো ইউরোপ-আমেরিকা গিয়ে সেটেল করতে পারবা। এই জিনিসটা আমি জানি। আর কখনোই বিদেশে গিয়ে সেটেল করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না, এখনো নেই। তাই সেই লোভের ফাঁদে পা দিইনি। তবে সবাই এমন নন, অল্প কয়েকজন এমন পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসেন। যারা এখন ক্রীড়া সাংবাদিকতা করছেন, তাদের সবার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। আমি ছেড়ে এসেছি বটে, তবে তা ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে খাটো করতে নয়। প্রতিদিন তারকাদের সঙ্গে ওঠাবসার যে সুযোগ, তা এখনো টানে। আমি শুধু আমার কাজের ক্ষেত্রটা বড় করতে চেয়েছিলাম। তবে ক্রীড়া এবং ক্রীড়া সাংবাদিকতার জন্য আমার অগাধ ভালোবাসা ছিল, আছে, আশা করি থাকবে।
মোস্তফা মামুনের লেখার ভক্ত আমি। শুধু খেলাধুলাবিষয়ক লেখা নয়, তার গদ্যের হাত অসাধারণ, গল্প বলার ঢং অননুকরণীয়। কালের কণ্ঠের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পরও এমন চমৎকার সব লেখা লেখেন কীভাবে? বইমেলার আগে নিশ্চয়ই তার ঘাড়ে প্রকাশকদের তাগাদার বিশাল বোঝা। ভয়ে ভয়ে সেই বিশাল বোঝায় চাপিয়ে দিলাম এইটুকু শাকের আঁটি। এত অল্প সময়ের নোটিশে এমন চমৎকার একটি ভূমিকা শুধু মামুনের পক্ষেই লেখা সম্ভব। ভূমিকা পড়ে আনন্দের চেয়ে লজ্জা পেয়েছি বেশি। এই বইয়ের সবচেয়ে ভালো লেখা মোস্তফা মামুনের এই ভূমিকাটুকুই। দুয়েকজন বোকা পাঠক যদি বইটি কেনেন তো মামুনের লেখার জন্যই কিনবেন।
সাবেক ক্যাবিনেট সচিব মুজিবুল হকের একটি থিওরি আমি সবসময় মেনে চলি। তিনি বলেছিলেন, সময়মত কোনো কাজ করাতে চাইলে, আপনার পাশের সবচেয়ে ব্যস্ত লোকটিকে কাজটি দিন। সেই থিওরি মেনেই মামুনকে ভূমিকা লিখতে বলেছিলাম। থিওরি আবারও ঠিক হলো, পান্ডুলিপির আগেই ভূমিকা হাজির।
প্রান্ত ঘোষ দস্তিদারের করা প্রচ্ছদটি বইয়ের নামের সঙ্গে কিছুটা বেমানান হয়তো। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বদলে যাওয়ার প্রতীকি ছবি এটি। খুলনা টেস্টে পাকিস্তানের ওয়াহাব রিয়াজের চোখে চোখ রেখে গলার রগ ফুলিয়ে সাকিবের জবাব দিতে পারাটাই এখন বাংলাদেশ। আমরা আর কাউকে ডরাই না।
প্রসূন আমার সব দোষ পায়নি। খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসাটা পেয়েছে। এই বইটা নিশ্চয়ই বাবার ছেলে আনন্দ নিয়ে পড়বে। আমি চাই প্রসূনরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলাটাও ভালোবাসুক। তাদের ছেলেবেলাটা হোক সুমনের গারেন মত ‘একটু পড়া, অনেক খেলা, গল্প শোনার সন্ধ্যে বেলা।’