ফ্ল্যাপে লিখা কথা পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ১১টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্ব মূলত তাদের প্রথাগত ভূমি অধিকারেই নিহিত। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ছাড়াই বলা চলে আদিবাসী শব্দের সমার্থক তাদের প্রথাগত অধিকার। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ বিষয়টি অতীত ও বর্তমানের আলোচনায় নানাভাবে জাতির বিবেকের আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে। তবে নানাবিধ আইনের বেড়াজালের মাঝে আদিবাসীদের সমষ্টিগত ভূমি অধিকার কীভাবে ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা বিম্বিত হয়নি বা হতে পারেনি। এমনই তমসাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে ‘প্রথাগত ভূমি অধিকার বনাম পার্বত্য আইন ও প্রশাসন’ বইটি আলোকসম্পাত করবে পার্বত্য আদিবাসী সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রথা, প্রচলিত আইন ও শাসন ব্যবস্থায় লুকিয়ে থাকা দুর্বলতা, অসঙ্গতির ওপর।
পিছিয়ে থাকা একটি জনপধের প্রান্তিক মানুষের জন্য সেই ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সময় পর্যন্ত জারি করা রেগুলেশন, ম্যানুয়েল, আইন ও অধ্যাদেশের বদৌলতে তাদের অধিকার ও অস্তিত্ব বনাম আইন ও প্রশাসন কিভাবে প্রতিপক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে তার বাস্তব চিত্র বইটিতে ফুটে উঠেছে।
প্রতিম রায় পাম্পু পেশায় একজন আইনজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৯৩ সালে। আইন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত গবেষণাধমী বেশ কিছু পুস্তক তিনি লিখেছেন। তন্মধ্যে ‘পার্বত্য আইনতত্ত্ব ও প্রয়োগে’ বইটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসী ১১টি জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন বিষয়ে প্রথম প্রকাশিত পৃথক ১১টি পুস্তকের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় প্রধান গবেষক হিসেবে তিনি কাজ করেন। চাকমা রাজ পরিবারের একজন সদস্য লেখক উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সময় সাংবাদিকতা পেশায়ও সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে রাঙ্গামাটিতে সরকারি কৌশুলীর দায়িত্ব পালন করছেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। ভূমিকা ১৯০০ থেকে ১৯৯৭, দীর্ঘ ৯৮ বছল পাহাড়ের শাসনতান্ত্রিক পথ পরিক্রমা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী মানুষদের জীবন চাকা ঘুরেছে ক্লান্তিহীন এই পরিক্রমায়। সময়ের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় বৃটিশ-পাকিস্তান পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বৃটিশ শাসনামলে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন দিয়ে অধিকার খর্বের সূচনা মাঝখানে পাকিস্তানি শাসনতন্ত্রে আদিবাসী প্রশ্নে কতো অস্ত্রোপচার। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অগ্নিপরীক্ষা হয়ে ১৯৯৭ সনের ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি। আদিবাসী মানুষের রক্ত আর ঘাম মিশে চেঙ্গী, সাঙ্গুঁ, কর্ণফুলীর পানি ঘোলা হয়েছে কতবার। তারপরও শ্রান্তিহীন, শান্তিহীন, স্বস্তিহী, সামর্থহীন আদিবাসী জীবনের চাকা সেই বন্ধুর পথ ভাঙছেই। পাহাড়ের রুক্ষ বুক চষে যে মানুষগুলো সোনা ফলায়, শ্বাপদসস্কুল বন জঙ্গলে যাদের বাঁচার লড়াই, তাদেরই ভাগ্যবিধাতা বড়ই নির্মম। সেই ১৯০০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত একটি বারও মুখ তুলে তাকায়নি তাদের প্রতি প্রসন্নতায়। পর্বতসস্কুল বন আর প্রকৃতিতে আঁকড়ে থেকে ভূমিজ সন্তানের দাবি নিয়ে বাঁচার সামান্য আকুতিকেই যেন বারবার পেষণ করা হয়েছে বিধি আর আইনের যাঁতাকলে। সেই বৃটিশ থেকে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী সকলেই শাসনের নামে শোষণের কৌশলগুলোকে নিরাপদ করতে, আদিবাসীদের পুরুষাণুক্রমিক ধারণা ও সমষ্টিগত আকাঙক্ষাকে মুছে দিতে নানা আইনি বেড়াজালে সঙ্কুচিত করেছে তাদের জীবন-জীবিকার বেষ্টনীকে। জুমভূমি, বনভূমি, পাহাড়ী ছড়া, ঝরনা, প্রকৃতি কোথাও আদিবাসী সত্তার নিরাপদ প্রতিবেশ নেই। পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই ভেঙে জীবিকার প্রাণান্তকর চেষ্টাটুকু যেন কেবলই মৃত্যুর শান্তি যাত্রার আশায়। জীবনের আর কোনো মানে নেই যাদের, সেই আদিবাসী জীবনের ভিন্নরূপও আছে শহুরে জীবনে। সরকারি আইন, বিধি-বিধান, প্রতিবিধান, রেগুলেশন, ম্যানুয়েল, তন্ত্র-মন্ত্র সবই আবর্তিত হয় সেই ভিন্নরূপের বলয়ে। বৃটিশ থেকে আজতক সুবিধা কেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক এই বলয়ের বাইরে কোনো সরকার একজন সাধারণ জুমিয়া পাহাড়ী মানুষের হৃদস্পন্দন শুনতে চায়নি। শাসকের স্বার্থসিদ্ধি আর সুবিধা কেন্দ্রিক বলয়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি এ দু’য়ের লেনদেনে ভেসে গেছে ভূমিজ সন্তানদের আত্মপরিচয়। যার ফলে সেই ১৯০০ থেকে আজও ক্লিষ্টতার আগুনে পুড়ছে পাহাড়ের জীবন স্পন্দন। প্রকৃতির অবারিত সম্পদ উজাড় হয়ে গেছে শহুরে গোলাতে। অভিশপ্ত জুমিয়া জীবন গেছে গারদে না হয় বারুদে। এভাবেই পার্বত্য আদিবাসী মানুষের ক্ষুদ্রতম অংশের প্রাচুর্যের আড়ালে বৃহত্তম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আজ অস্তিত্ব বিনাশী পথে ধাবিত হয়েছে। বৃটিশের রেগুলেশন, পাকিস্তানি শাসনতন্ত্র, বাংলাদেশের পার্বত্য চুক্তি কোনো তন্ত্র-মন্ত্রই তাদের মেরুদণ্ডকে মানুষেল মতো খাঁড়া করেনি। পাহাড়ী সমাজকে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলো আকাশ ছুঁতে চাইলেও তার কোলে বেড়ে ওঠা ক্লিষ্ট মানুষগুলো ভূতল খুড়ছে ক্ষুধার জ্বালায়। রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান, আইন কেউই দেখে না জীবনের প্রতি এই হিংস্র উপহাস। শাসনের নামে শোষণ, অিধিকারের নামে প্রতারণা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার যে কঠিন বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে শাসক-শোষক শ্রেণী গত ১০৯ বছরে, তাকে ছিন্নভিন্ন করার সামর্থ কোথায়? রাষ্ট্র, সংবিধান, সরকার, প্রশাসন কোথায় এ সামর্থ লুকানো, তার সদুত্তর হয়তো ভবিষ্যৎ বলে দেবে। ভবিষ্যতকে সেই সদু্ত্তর দেবার সামর্থ যোগাতে এই গ্রন্থে কেবল কিছু মীমাংসা খোঁজা হয়েছে।
আমার এ গ্রন্থ-রচনার সময় আমাকে বিভিন্ন সময়ে তথ্য দিয়ে সার্বিক সহায়তা করেছেন প্রবীণ আইনজীবী জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, প্লিনা চাকমা ও বন্ধু যশেশ্বর চাকমা। তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। গ্রন্থটি রচনার পর ভাষা বিন্যাসের ক্ষেত্রে সার্বিক সহায়তা করেছেন বন্ধুবর শ্রদ্ধেয় বড়ভাই সাংবাদিক শৈলেন দে এবং হাসান মাহমুদ টিপু যাদের ঋণ শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তাদেরওক অসম্মান করা হবে।
প্রতিম রায় পাম্পু
সূচিপত্র * পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি আইন ও ভূমি প্রশাসন * আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার * সরকার নিয়ন্ত্রিত বন ও বনাঞ্চলের প্রশাসন * সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমি ব্যতীত অন্যান্য ভূমি * ভূমি সংঘাত ও ভূমি বিরোধ * উপসংহার * চিত্রাবলী