ধানমণ্ডি কলাবাগান ওভার ব্রিজের পাশের গলির শেষ প্রান্তের বিল্ডিংটায় একটা ছেলে থাকে। বয়স কতো হবে, চব্বিশ কিংবা পঁচিশ। ছেলেটার পৈতৃক নাম মুহাব্বত। গ্রামে সবাই তাকে ওই মুহাব্বত নামেই ডাকে। ... See more
ধানমণ্ডি কলাবাগান ওভার ব্রিজের পাশের গলির শেষ প্রান্তের বিল্ডিংটায় একটা ছেলে থাকে। বয়স কতো হবে, চব্বিশ কিংবা পঁচিশ। ছেলেটার পৈতৃক নাম মুহাব্বত। গ্রামে সবাই তাকে ওই মুহাব্বত নামেই ডাকে। নামের মধ্যেও যে একটা ব্যাপার থাকে, এই ব্যাপারটা মুহাব্বত যখন বুঝলো তখন সে তার মা- বাবার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেলো। বাবার সামনে দাঁড়াতে না পারলেও একদিন সে তার মায়ের কাছে এসে বললো, 'মা, বাংলা অভিধানে কি শব্দের সংকট পড়ছিলো? কি নাম রাখছো এটা, মুহাব্বত। মুহাব্বত কোন নাম হলো? আদিম আমলের নাম। এই নাম আধুনিক যুগে বেমানান।' তার মা বললেন, 'নামের আবার মানান বেমানান কীরে! নাম একটা হলেই হলো। নাম হলো পরগাছা। সে বাঁচে কর্মের ওপর। নাম নিয়ে চিন্তা ফিকির না করে কর্মের ওপর মনোযোগ দে। পড়াশুনা ঠিকমতো কর।' মুহাব্বত এসব শোনে না। সে জীবন দেবে তবু এই নাম বহন করবে না।
মানুষের জীবন অদ্ভুত। তার চাওয়া পাওয়া অদ্ভুত। মানুষ আসলে কি চায়? যাকে সে ভালোবাসে। যাকে পাওয়ার জন্য প্রাণপণ করে অথচ একসময় তাকেই কেন কষ্ট দেয়? মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’র মধ্যে লেখক মানুষের আত্মিক সম্পর্ক, প্রেম ও বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়নের চমৎকার চিত্র তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
উপন্যাসের কাহিনী এগিয়েছে বেশ ধীর এবং সাবলীলভাবে। একটু একটু করে যতোই উপন্যাসের এগোচ্ছি ততোই যেন উপন্যাস আমাকে মুগ্ধ করছে। উপন্যাসের কাহিনী যেন বারবার মোড় নিচ্ছে। লেখক উপন্যাসে অতীত এবং বর্তমানের কাহিনী পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন বেশ দক্ষতার সাথে। উপন্যাসর কাহিনীতে যোগ করেছেন চমৎকার টুইস্ট।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের নাম নিমা। লেখক এই চরিত্রটিকে চমৎকারভাবে এঁকেছেন এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই মূলত উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়। উপন্যাসের শুরুতেই নিমার দেখা পাওয়া যায় কমলাপুর রেলস্টেশনে এবং তাকে পাঠকের সাথে লেখক প্রথম পরিচয়টাও ঘটিয়ে দিয়েছেন চমৎকারভাবে-- ‘প্লাটফর্মের প্রতিটি স্বাস্থ্যবান খাম্বার গায়ে মেঝে থেকে প্রায় একহাত ওপরে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রসারিত বৃত্তাকার জায়গা আছে। খাম্বার এমনই একটা বৃত্তাকার শাখায় মুহিব বসে আছে। তার আশপাশে আরও অনেকেই বসেছে। পুরো শাখা পূর্ণ। হঠাৎ মুহিব লক্ষ্য করলো তার ঠিক আড়াআড়িভাবে পেছনে এমন আরেকটা বৃত্তে বসে থাকা মধ্যবয়সী একজন রমণী একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রমণীটির গায়ের রঙ অতিরিক্ত পরিমাণে ফর্সা। পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি। চোখে শেখ মুজিবীয় প্রকৃতির একটা চশমা। কোলের মধ্যে খয়েরি রঙের একটা ভ্যানিটি ব্যাগ দু’ হাতে চেপে ধরেছে। শাড়ির রঙের সাথে সাদৃশ্য রেখে কপালে যদিও হালকা নীল রঙের একটা টিপ থাকার কথা ছিলো কিন্তু মুহিব সেটা দেখতে পেলো না। হালকা নীল শাড়ি পরা রমণীর কপালে হালকা নীল রঙের কোন টিপ নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষের কবিতায় লাবণ্যের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে অমিতের মুখে বলেছেন, ‘আমি অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছি যাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমা রাত্রির মতো উজ্জ্বল অথচ আচ্ছন্ন, কিন্তু বন্যার সৌন্দর্য সকাল বেলার মতো, তাতে অস্পষ্টতার কোন মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত।’ কিন্তু এই অত্যুজ্জ্বল রমণীটিকে মুহিব কিছুতেই রবি ঠাকুরের ওই অনেকের মধ্যে ফেলতে পারছে না। রমণীটির সৌন্দর্য আচ্ছন্ন নয় বরং প্রচ্ছন্ন। একটু চোখ মেলে তাকালেই তার সৌম্য সৌন্দর্য ধরা পড়ে। ’
সর্বোপরি উপন্যাসের ভাষা অনেক শক্তিশালী। চমৎকার কাহিনীর সঙ্গে বর্ণনার অসাধারণ দক্ষতা উপন্যাসটিকে অনন্য করে তুলেছে। আমার রেটিং- ৫/৫