আধুনিক বাংলা সাহিত্যধারায় প্রাতিস্বিক ব্যক্তিত্ব বলাইচাঁদ মুখােপাধ্যায়; সারস্বত সমাজে যার পরিচিতি বনফুল ছদ্মনামে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর শিল্পচর্চায় বনফুলের বিচরণ রােম্যান্টিক কিংবা স্বপ্নবিলাসী পরিমণ্ডলে নয়; বরং চিরায়ত মানবভুবনে। তার সাহিত্যভাবনা তত্ত্বচালিত কিংবা ইজমনির্ভর নয়; তিনি মানুষকে দেখেছেন মানুষী দৃষ্টিভঙ্গিতে। উত্তর-তিরিশি বাংলা ছােটগল্পশিল্পে তিনি যুক্ত করেছেন নতুনত্বের আস্বাদ। মানবজীবন সম্পর্কে এক অসামান্য কৌতূহলসঞ্জাত অনুভূতি ও সহমর্মিতা। তাঁর ছােটগল্পকে দিয়েছে বিরল স্বকীয়তা। চিকিৎসা পেশার অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানদৃষ্টি ও শিল্পীর হৃদয়ানুভূতি নিয়ে তিনি রচনা করেছেন ৫৮৬টি ছােটগল্প। এসব গল্পে রয়েছে মানুষ ও তার অন্তস্তল উৎসারিত গভীর-গােপন রহস্য। তাঁর গল্পের একটি বিশিষ্ট আঙ্গিক হচ্ছে অণুগল্প । কখনও একপৃষ্ঠা, কখনও অর্ধপৃষ্ঠায় সমাপ্ত এসব গল্পের উপজীব্য বিষয় অতি সাধারণ নরনারীর অনাড়ম্বর জীবনাচার। এছাড়াও নকশাধর্মী, দীর্ঘায়তনবিশিষ্ট, রূপক, অতিপ্রাকৃত, ফ্যান্টাসিধর্মী, ব্যঙ্গ-স্যাটায়ারআয়রনি ইত্যাদি বিচিত্রমাত্রিক গল্পও রচনা করেছেন তিনি। বাংলা ছােটগল্পসাহিত্যে তাঁর প্রয়াস যেমন নিরীক্ষাধর্মী তেমনি দুঃসাহসিক।
আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় । জন্ম: ১৯ জুলাই, ১৮৯৯ সালে। তিনি একজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি। তিনি বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যেরমনিহারীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের পিতার নাম ডা. সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও মাতা মৃণালিনী দেবী। তাদের আদি নিবাস হুগলী জেলার শিয়াখালা। কিন্তু তিনি বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ । প্রথমে মণিহারী স্কুলে এবং পরে সাহেবগঞ্জ জেলার সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়া করেন। শেষোক্ত স্কুল থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আই.এস.সি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে। কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন তবে পাটনা মেডিক্যাল কলেজে থেকে এম.বি, ডিগ্রী লাভ করেন। প্যাথলজিস্ট হিসাবে ৪০ বৎসর কাজ করেছেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে তিনি বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নিয়মিত প্রবাসী, ভারতী এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, ৫৮৬টি ছোট গল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলীসমগ্র ২২ খণ্ডে প্রকাশিত। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি 'পদ্মভূষণ' উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়।