অনিবার্যভাবেই মানবতন্ত্রী সাহিত্যের প্রধান বিষয় হচ্ছে-মানুষের অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সৃষ্টিশীলতাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আলোকিত করা। মানুষ তার আপন বোধবুদ্ধি, যুক্তিতর্ক ও নিষ্ঠা দিয়ে, শ্রেষ্ঠ এবং অক্লান্ত শ্রম ও মেধার বলে তার ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে-এই ধারণা ও বিশ্বাস ছিল রেনেসাঁ-উত্তর আধুনিক সাহিত্যের মূলমন্ত্র। কিন্তু ইউরোপে এই ধারা ক্রমশই হারিয়ে যায় এবং সেখানে স্থান করে নেয় অমানবতন্ত্রী সাহিত্য বোধের। আব্দুর রউফ চৌধুরী অমানবতন্ত্রী পাশ্চত্য সাহিত্যে প্রভাবিত হলেও তার স্বকীয় জীবনোপলব্ধি থেকেই তিনি নিষ্ঠুর, নির্মম ও বিকারগ্রস্ত মানুষগুলোকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই রেনেসাঁ-উত্তর আধুনিক সাহিত্যে মানুষের প্রতি যে বিশ্বাস ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়-মহিমামণ্ডিত, প্রতিশ্রুতিশীল ও রুচিশীল মানুষের যে ভিড় লক্ষ করা যায়-আব্দুর রউফ চৌধুরী সেখানে মানুষের সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার কথা, এমনকি মানুষের মনুষ্যত্বহীনতার দিকগুলো প্রকটভাবে তুলে ধরেছেন। আর তাই তার কাছে এসে মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের চির আদি বিশ্বাসের স্রোতধারাটি মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আর তাই তার সমসাময়িক কালের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসহ জাতিক-আন্তর্জাতিক সময় ও সমাজপ্রবাহের অন্তরলালিত মানব-অস্তিত্বের সর্বগ্রাহী সমস্যাই 'অনিকেতন' উপন্যাসে শিল্পরূপ লাভ করে। 'অনিকেতন' উপন্যাসে, প্রবাসী বাঙালির জীবন-সঙ্কট প্রথাগত মূল্যবোধের সঙ্গে প্রত্যাশিত মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। বিলাতি স্নিগ্ধতা-মণ্ডিত স্বপ্নলোক থেকে এই উপন্যাসের মানব-মানবীরা বহু দূরবর্তী।
জন্ম : ১লা মার্চ ১৯২৯। মুকিমপুর গ্রাম, হবিগঞ্জ। মৃত্যু : ২৩ ফেব্র“য়ারি ১৯৯৬। স্কাউট ভবন, হবিগঞ্জ সদর। হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে বি.এ শেষ বর্ষ সমাপ্তির পূর্বেই আউশকান্দি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে সপরিবারে পাকিস্তানে বসবাস শুরু। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বিমান বাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সপরিবারে দেশে প্রত্যাবর্তন। ১০ জানুয়ারি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে পৌঁছানো ও পরে ব্রিটিশ সরকারের এরোপ্লেন গবেষণা কেন্দ্রে স্পেশাল গ্রেডের চাকরিতে যোগদান। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমাগত পেশা বদল। ম্যানেজার, ইলেকট্রিক, মিস্টি, ফিটার। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি তাঁর বিচিত্র জীবনের অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে শুরু করেন। আবদুর রউফ চৌধুরীর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অসংখ্য উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, সাহিত্য ও রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।