আমের ভিতরে আছে একটি অনবচ্ছিন্ন শাঁস, আর তার মাঝখানটিতে একটিমাত্র আঁঠি। দাড়িমের শক্ত খোলার মধ্যে শত শত দানা, এবং প্রত্যেক দানার মধ্যেই একটি করে বীজ। তোমার অন্তঃশীলা সেই দাড়িম জাতীয় বই। বীজ-বাণীতে ঠাসা। তুমি এত বেশি পড়েছ এবং এত চিন্তা করেছ যে তোমার ব্যাখ্যান তোমার আখ্যানকে শতধা বিদীর্ণ করে বিস্ফুরিত হতে থাকে। আমার বোধ হচ্ছিল তোমার এই গল্পটি তোমারি চরিতকথা, গল্পের দিক থেকে নয়, আচরণের দিক থেকে। আমাদের জীবনটা প্রধানত সুখদুঃখ জড়িত ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত। তোমার জীবনে ছোটোবড়ো, অভিজ্ঞতাগুলি চিন্তা উৎকীর্ণ করবার উপলক্ষ্যরূপে প্রাধান্য লাভ করে।... তোমার গল্পের পাত্রগুলি জীবনযাত্রায় একটু ঠোকর খেলেই তাদের মাথা থেকে ভাবনা ছিটকে পড়তে থাকে। তারা কী ভাবে সেইটেই সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়, কী অনুভব করে সেটা চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু দেখা দেয়। জোর করে বলতে পারিনে কিন্তু আমার বিশ্বাস এটা তোমারি চরিত্র। হয়তো আমিও আমার গল্পে নিজেকে প্রকাশ করে থাকি। আমার প্রকাশ যুক্তিতে নয় চিন্তায় নয়, কল্পনায় ছবিতে সুরের ইসারায়।... আমার পাত্ররা আমারই মতো কল্পনাশীল, তোমার পাত্ররা তোমারই মতো চিন্তাশীল; তোমার দলে লোক বেশি নেই একথা মনে রেখো,-ভাবতে বললে মানুষ চটে ওঠে, অথচ এই বইয়ের প্রত্যেক পাতায় তুমি লোককে ঠেলা মেরে বলেচ, ভেবে দেখো।
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯০৯ সালে বারাসাত স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯১২ সালে রিপন কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও অর্থনীতিতে এমএ (১৯১৮, ১৯২০) ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২২-৫৪) ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৪-৫৯) অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৪৫ সালে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে উন্নীত হন এবং ১৯৪৯ সালে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাঝে তিনি উত্তর প্রদেশ সরকারের প্রচার বিভাগের উপদেষ্টা (১৯৩৮-৪০) এবং লেবার এনকোয়ারি কমিটির সদস্য (১৯৪৭) নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর তিনি হেগ শহরে সোশ্যাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটে সমাজতত্ত্বের অতিথি অধ্যাপক হয়ে ‘সোসিওলজি অব কালচার’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন (১৯৫৩-৫৪)। ১৯৫৫ সালে তিনি বান্দুং সম্মেলনে যোগ দেন এবং ১৯৫৭ সালে ইন্ডিয়ান সোসিওলোজি কনফারেন্সের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশ-বিদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় বহু মননশীল প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সবুজপত্র ও পরিচয় পত্রিকার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ধূর্জটিপ্রসাদ বাংলা গদ্যরীতিতে প্রমথ চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। তাঁর মুখ্য পরিচয় একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে। অন্তঃশীলা (১৯৩৫), আবর্ত (১৯৩৭) ও মোহানা (১৯৪৩) তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস। এতে সমকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে নর-নারীর প্রেম ও আত্মজিজ্ঞাসার কথা আছে। ত্রিধারা তাঁর অপর উপন্যাস। গদ্যগ্রন্থের মধ্যে আমরা ও তাঁহারা (১৯৩১), চিন্তয়সি (১৯৩৪), সুর ও সঙ্গতি (১৯৩৭), কথা ও সুর (১৯৩৮), মনে এলো, ঝিলিমিলি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রধান কয়েকটি ইংরেজি রচনা হলো: Basic Concepts of Sociology, Modern Indian Culture (১৯৩০), Personality and Social Sciences (১৯৩৪), Tagore- A study (১৯৪০), On Indian History (১৯৪৪), Views and Counterviews, Diversities, Indian Music ইত্যাদি। অবসর জীবনে ধূর্জটিপ্রসাদ দেরাদুনে অবস্থান করেন (১৯৫৫-৬১), কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬১ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। [শিপ্রা দস্তিদার]