শাহবাগ চারুকলার অপজিট। জমজমাট শিল্প সাহিত্যের আড্ডায় মুখর ছবির হাট। গেইট দিয়ে ভিতরে ডুকলেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এই উদ্যানের পূর্ব নাম রেসকোর্স ময়দান। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই উদ্যানটি। এখানেই স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাতই মার্চের ভাষণের স্থানটি এখনো সংরক্ষিত। এই উদ্যানেই পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিলো, সম্প্রতি এখানে নির্মিত হয়েছে কাঁচের টাওয়ার। রাতের বেলা এটা কৃত্তিম চাঁদের মতো আলোকিত করে রাখে উদ্যানের সবুজ বৃক্ষরাজীকে। উদ্যানের ভিতরে আছে- মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আছে দৃষ্টি নন্দন শিখা চিরন্তন। স্বাধীনতার মশাল বুকে জ্বেলে দিনরাত দাউদাউ করে জ্বলছে আপন মনে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনের দিকে যেতে হাতের ডানে একটা উঁচু ঢিবির উপর বট গাছের নিচে একজন মাটির মানুষ আপন মনে বসে বসে গান গায়, নিজের গান নিজের সুর, একটা নিজস্ব গায়কী। কেউ শুনে কেউ শুনেনা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি লোকটা আপন মনে গেয়ে চলে, সকাল দুপুর রাত।
চোখে দেখেন না কিন্তু অনেক বেশি প্রখর তাঁর বোধের ইন্দ্রীয়। ভাবনায় বাংলাদেশ, দেশ মাতৃকার চেতনা। তাঁর গান সমকালীন আর জীবন ঘনিষ্ঠ। তাঁর গান ভোরের শিশিরের মতো। তাঁর গান রাতের পাখি আর দুপুরের ক্লান্ত কুকুর নিয়ে, তাঁর গান জীবন আর জীবিকা নিয়ে, তাঁর গান চেতনার স্ফুরণে তুলে ভাবনার ঝড়। তাঁর গানে শহরের ইট কাঠ, সমকালীন রাজনীতি, অন্যদিকে গ্রামের শিশির ভেজা পথ, খেজুরের রস। তাঁর গানে গানে বাংলার গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত। তাঁর গান টানারোদে বর্ষণের পর ঝলমলে সাতরঙা রংধনু। তাঁর গানে আছে দয়িতা, প্রেমিক, শোষক, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীপেশার মানুষের কথা। গানে গানে একটা ভিন্ন আর উন্নত জীবনের গল্প বলে যান এই লোকটা। লোকটার নাম পৃথক তুহিন। টানা ৮ বছর ঘুমিয়ে আছেন খোলা আকাশের নিচে মাটির বিছানায়। গাছের নিচেই তার যাপিত জীবন।
পৃথক তুহিন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চোখে দেখেন না। তাই লেখার কোন উপায় নেই, তাছাড়া ঘরহীন পাখি জীবনে এসব হয়ও না। পৃথক তুহিনের রচিন গান হাজার ছাড়িয়ে, সব গান মুখে মুখে রচিত, নিজের সুর আর নিজের গায়কী। প্রথম উনার গান শুনে উনার যাপিত জীবন দেখে হতবাক হয়ে যাই। মনে মনে ভাবতে থাকি তার অগোছালো জীবন যে কোন সময় যবনিকায় পৌঁছে যেতে পারে, অবশ্যই গানগুলো সংরক্ষণ করা উচিৎ। সেই ভাবনা থেকেই ধীরে ধীরে সময় নিয়ে গানগুলো লিখতে থাকি উনার অনুমতিক্রমে।
গান সংকলনের পাশাপাশি ভাবতে থাকি পৃথক তুহিনের পৃথক বাক্য আর গানগুলো কিভাবে গ্রন্থিত করা যায়। অনেক প্রকাশকের দ্বার ঘুরে বিষয়টা লোকজ প্রকাশনীর প্রকাশক ইলিয়াস আলীকে বলতেই- উনি সানন্দে বই প্রকাশে রাজি হয়ে যান। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি লোকজ প্রকাশনীর প্রকাশক ইলিয়াস আলীর কাছে, আপাদমস্তক গানপ্রেমী প্রবাসী এই বঙ্গসন্তান একজন গীতিকার, লেখক ও লোকসাহিত্য গবেষক। সাধুবাদ জানাই বাংলা গ্রন্থ প্রণয়নে তাঁর প্রকাশনার মতো একটি সময়োপযোগী কর্মে মনোনিবেশ করার জন্য, প্রত্যাশা করি পৃথক তুহিনের মতো বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য লেখকের লেখা সাদা কাগজের বুকে কালির ছাপচিত্র আঁকবে তাঁর হাত ধরে।
সবিনয়ে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- গান যতটা না পড়বার তার চেয়ে বেশি শুনবার বিষয়। গানের গীত শ্রবণ আর কথা পাঠের মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। প্রচেষ্টা চলছে- পৃথক তুহিনের গানগুলো রেকর্ড করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার। যে কোন হৃদয়বান পাঠক এই কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। কালের লিখন কবি, গবেষক ও বহুমাত্রিক লেখক।