শাপলা জাকিয়া বর্তমান প্রজন্মের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কথাশিল্পী। মেদহীন ঝরঝরে গদ্যে চমকপ্রদ বস্তুনিষ্ঠ সাবলীল গল্প বলায় তার পারদর্শিতা মনোমুগ্ধকর। শাপলা জাকিয়ার শব্দের সাথে শব্দের যোগ আর লব্ধ উপলব্ধ, পাঠককে নিয়ে যায় এক অদ্ভুত দ্যোতনায়, অচেনা আলোয় এই গুনি কথাশিল্পী অনায়াসে বলে যান- চেনা জীবনের সাতকাহন। যাপিত জীবনের ছোটখাটো খুঁটিনাটি উঠে আসে তার গল্পের আলো ছায়ায়। শাপলা জাকিয়ার চরিত্রেরা জীবন্ত, চলিষ্ণু এবং বহমান। তার গল্পের 'আমি' ভূমিময়, তার গল্পের 'হৃদয়' ব্যক্তি ছাড়িয়ে সামগ্রিক, তার গল্পের 'সময়' কাল ছাড়িয়ে কালান্তিক। শাপলা জাকিয়ার নির্মিত চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সম্পর্কের টানাপড়েন, আর বোধের দোলাচল আমিত্ব ছাড়িয়ে হয়ে উঠে বৈশ্বিক, এখানেই বোধকরি কথাশিল্পীর জীবনমূলক উত্তরণ।
শাপলা জাকিয়ার গল্পে প্রত্যাশার মাঝেও যেন আরও খানিকটা প্রত্যাশা থাকে। চেনা গণ্ডির মধ্যে থেকেই অচেনা কোন মানুষের অনুভব সময় ছুঁয়ে ছবি আঁকে। প্রাপ্তির কোলঘেঁষে অপ্রাপ্তির হাহাকার বুকে নিয়ে ধেয়ে চলে শাপলা জাকিয়ার গল্পের তরী। এই গল্পের তরীতে কখনো উঠে আসে- ব্যক্তিগত বাদানুবাদ, কখনো বিজ্ঞান মনস্কতা, কখনো সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কখনো গল্পের তরীতে শব্দের ঢেউ লেগে দুলে উঠে- পারস্পরিক মধুর প্রেমের সরল রসায়ন। যেখানে স্থাণু লালসা ত্যাগ করে অসীম বলয়ে মিশে যায় লেনাদেনার দোলাচল। তুমুল জীবনঘেঁষা প্রতিটি মুহূর্ত বলে যায়- মূলক জিজ্ঞাসার অন্য নামই জীবন। তাই শাপলার গল্পের চরিত্রেরা ছেঁড়া ছেঁড়া একাকীত্বে বসবাস করেও শেষ পর্যন্ত হয় দাঁড়ায় সামগ্রিক অনুভবের অগ্রদুত হয়ে।
শাপলা জাকিয়ার প্রতিটি গল্পের মাঝেই যেন আর একটা গল্প লুকায়িত থাকে, অনেকটা রবি ঠাকুরের সেই পরিচিত হাহাকার- "শেষ হইয়াও হইলো না শেষ" এর মতো। অন্যদিকে ব্যক্তিস্বত্বা ছাপিয়ে লেখকসত্ত্বার প্রভাবে শাপলা জাকিয়া হয়ে উঠেন নির্মোহ ঋষির মতো ধ্যানী। তার গল্পের চরিত্রগুলোর স্খলন, পতন বা উত্তরণ হয় সময়ের হাত ধরে। শাপলা জাকিয়ার গল্প পড়ে ঠিক গল্পপাঠ অনুভূত হয় না। মনে হয় যেন পরিপাটি স্বভাবজাত এক কথকের মুখে ঘটমান কোন সত্যের বয়ান শুনছে মহাকাল। গল্পগ্রন্থ 'খুন' আক্ষরিক অর্থেই শুধু খুন নয়, এর মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়া আরও গভীরে। তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকের গল্প নিয়ে ছোট পরিসরে বেশ বড় আয়োজন কথাশিল্পী শাপলা জাকিয়ার। এই কথার আবাদ সময় পরিক্রমায় আরও বিস্তৃত হবে এই প্রত্যাশা করি।