"বাল্মীকি রামায়ণ" বইয়ের ভূমিকাঃ বাল্মীকি আদিকবি এবং তাঁর রামায়ণ আদি মহাকাব্য, এই প্রসিদ্ধি আছে। বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত করেছেন, প্রচলিত গ্রন্থের সবটা একজনের বা এক সময়ের রচনা নয়। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দে মূল গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, তার সঙ্গে অনেক অংশ পরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন উত্তরকাণ্ড। প্রক্ষিপ্ত যতই থাকুক তা-ও বহুকাল পূর্বে মূলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে এবং সমগ্র রচনাই এখন বাল্মীকির নামে চলে। ভারতীয় কবিগণনায় প্রথমেই বাল্মীকির স্থান, কিন্তু তাঁর রামায়ণ এত বড় যে মূল বা অনুবাদ সমগ্র পড়বার উৎসাহ অতি অল্প লােকেরই হয়। এই পুস্তক বাল্মীকি-রামায়ণের বাংলা সারসংকলন, কিন্তু সংক্ষেপের প্রয়ােজনে এতে কোনও মুখ্য বিষয় বাদ দেওয়া হয়নি। বাল্মীকির রচনায় কাব্যরসের অভাব নেই, প্রাচীন সমাজচিত্র, নিসর্গবর্ণনা এবং কৌতুকাবহ প্রসঙ্গও অনেক আছে যা কৃত্তিবাসাদির গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এই সংকলনে বাল্মীকির বৈশিষ্ট্য যথাসম্ভব বজায় রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে এবং তাঁর রচনার সঙ্গে পাঠকের কিঞ্চিৎ সাক্ষাৎ পরিচয় হবে। এই আকাঙ্ক্ষায় স্থানে স্থানে নমুনা স্বরূপ মূল শ্লোক স্বচ্ছন্দ বাংলা অনুবাদসহ দেওয়া হয়েছে। পাঠকের যদি রুচি না হয় তবে পড়বার সময় উদ্ধৃত শ্লোকগুলাে অগ্রাহ্য করতে পারেন। রামায়ণে সত্য ঘটনা কতটুকু আছে, রূপক বা nature myth কতটুকু আছে, রামায়ণ-কার বাল্মীকি বাস্তবিকই রামের সমকালীন কি না— এইসব আলােচনা এই ভূমিকার অধিকারবহির্ভূত। কেবল একটি বিষয় লক্ষণীয়— ভারতীয় সাহিত্যে রামবিষয়ক কথা অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলাের আখ্যানভাগ সর্বাংশে সমান নয়। মহাভারতের আদিপর্বে একটি শ্লোক আছে— আচ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে। আখ্যাস্যন্তি তথৈবানন্য ইতিহাসমিমং ভুবি । অর্থাৎ, কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরাও বলবেন। এই উক্তিটি রামায়ণ সম্বন্ধেও খাটে। রামবিষয়ক গাথা ও জনশ্রুতি অতি প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত ছিল, তাই অবলম্বন করে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন কবি নিজের রুচি অনুসারে আখ্যান রচনা করেছেন এবং পূর্ববর্তী রচয়িতার সাহায্যও নিয়েছেন। এই কারণে মহাভারত-পুরাণাদিতে বর্ণিত আখ্যান বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে সর্বত্র মেলে না। কৃত্তিবাস তুলসীদাস প্রভৃতি কবিরা বাল্মীকির যথাযথ অনুসরণ করেননি, আখ্যানের অনেক অংশ পুরাণাদি থেকে নিয়েছেন। বাল্মীকি রামকে বিষ্ণুর অবতার বললেও তাকে সুখদুঃখাধীন মানুষ রূপেই চিত্রিত করেছেন, কিন্তু কৃত্তিবাসাদি রামচরিত্রে প্রচুর ঐশ লক্ষণ জুড়ে দিয়েছেন। পুরাণকথার একটি মােহিনী শক্তি আছে। যদি নিপুণ রচয়িতার মুখ বা লেখনী থেকে নির্গত হয় তবে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলকেই মুগ্ধ করতে পারে। প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি আমাদের একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে, তার ত্রুটি আমরা সহজেই মার্জনা করি। শিশু যেমন রূপকথার অবিশ্বাস্য ব্যাপার মেনে নিয়ে গল্প শােনে, আমরাও সেইরূপ পৌরাণিক অতিশয়ােক্তি ও অসঙ্গতি মেনে নিয়ে প্রাচীন সাহিত্য উপভােগ করতে পারি। এর জন্য ধর্মবিশ্বাস বা পূর্বসংস্কার একান্ত আবশ্যক নয়, উদার পাঠক সর্বদেশের পুরাণই সমদৃষ্টিতে পাঠ করতে পারেন। বাল্মীকির গ্রন্থে রূপকথা ও আরব্য উপন্যাসের তুল্য বিচিত্র অতিপ্রাকৃত বর্ণনা অনেক আছে, কাব্যরসও প্রচুর আছে, কিন্তু এর আখ্যানভাগই সাধারণ পাঠকের সর্বাপেক্ষা চিত্তাকর্ষক। বাল্মীকিকথিত এই অতি প্রাচীন আখ্যান কোনও আধুনিক উপন্যাসের চেয়ে কম মনােহর নয় । তথাপি মনে রাখা আবশ্যক, আমরা যে সংস্কার নিয়ে আধুনিক ঘটনা বা উপন্যাস বিচার করি তা নিয়ে রামায়ণবিচার চলবে না। বাল্মীকি তৎকাল-প্রচলিত কথারচনার রীতি ও নৈতিক আদর্শ অনুসারে নায়কনায়িকাদির চরিত্র বিবৃত করেছেন। রামের পত্নীত্যাগ ও রাজ্যরক্ষা, এবং অষ্টম এড়ােআর্ডের রাজ্যত্যাগ ও পত্নীবরণ— এই দুই ব্যাপারের ন্যায়-অন্যায় একই সামাজিক অবস্থা ও ধর্মনীতি অনুসারে বিচার করলে প্রচণ্ড মূঢ়তা হবে। যার পিতার তিনশাে পঞ্চাশ পত্নী সেই রাম চিরকাল এক ভার্যায় অনুরক্ত রইলেন— পুরুষের একনিষ্ঠতার এই আদর্শ সেকালের পক্ষে কত বড় তা আমাদের আধুনিক বুদ্ধিতে ধারণা করা অতি কঠিন। ভ্রাতৃভক্ত লক্ষ্মণ দশরথকে মারতে চেয়েছেন, কৌশল্যারও তাতে বিশেষ আপত্তি নেই; হীন সন্দেহের বশে সীতা লক্ষ্মণকে নির্মম ভৎসনা করেছেন, ultimatum না দিয়েই রাম বালীকে আড়াল থেকে বধ করেছেন; রাবণবধের পর রাম অত্যন্ত কটু ভাষায় সীতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, দ্বিজাতির অধিকার রক্ষার জন্য শূদ্রতপস্বী শম্বুককে হত্যা করেছেন— অতীতকালের অতি প্রাচীন সমাজের এইসব ঘটনার বা কবিকল্পনার নিরপেক্ষ বিচার করতে পারি এমন দেশকালজ্ঞ আমরা নই। আমাদের সৌভাগ্য, আধুনিক সংস্কারের পীড়াকর কথা রামায়ণে বেশি নেই, এমন কথাই বেশি আছে যা সর্বকালে উপাদেয় অনবদ্য ও হিতকর। দশরথের তীব্র পুত্রস্নেহ, রামের প্রতি অযােধ্যাবাসীর গভীর অনুরাগ, নিষাদরাজ গুহের সহৃদয়তা, অরণ্যভূমির মনােহর বর্ণনা, বানরবীরগণের নিঃস্বার্থ কর্মচেষ্টা, বাল্মীকির কারুণ্য, সীতার অপরিসীম মাধুর্য সারল্য ও মহত্ত্ব, রামের গাম্ভীর্য সত্যনিষ্ঠা উদারতা ও দারুণ কর্তব্যবুদ্ধি— এই সমস্ত মিলে পাঠকের মনকে শুধু রসাবিষ্ট করে না, প্রসারিত এবং উত্তোলিতও করে।
ছদ্মনাম পরশুরাম। জন্ম ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ, মঙ্গলবার। বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের সন্নিকটে বামুনপাড়া গ্রামে, মামা বাড়িতে। পৈত্রিক নিবাস নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী উলা বীরনগর। বাবার নাম চন্দ্রশেখর বসু। তিনি সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রের অনুরাগী ছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত বেদান্তদর্শন, বেদান্তপ্রবেশ, সৃষ্টি, অধিকারতত্ত্ব, প্রলয়তত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থ সেকালে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বাবার সঙ্গে লেখকের বাল্যকাল কেটেছে বাংলার বাইরে। মুঙ্গের জেলার খড়্গাপুরে। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার রাজ স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭ পাটনা কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৯৭ সালে ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। ১৮৯১ সালে কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পাস করেন। ১৯০০ সালে রসায়ন শাস্ত্রে এম.এস.সি-তে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। বেঙ্গল কেমিকেল ওয়ার্কস-এ চাকরি শুরু করেন। ১৯০৩ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানে প্রভূত উন্নতি সাধন করে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্যের উপর ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। বিশেষ করে হাস্যরসাত্মক রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাংলা সাহিত্যে পরশুরাম ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ করেন এবং রম্য-রচনার মাধ্যমে পাঠকদের মন জয় করেন। হয়ে ওঠেন বাংলার হাস্যরসাত্মক রচনার শ্রেষ্ঠ লেখক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি : কজলী, গড্ডালিকা, লঘুগুরু, নীলতারা, কৃষ্ণকলি, লম্বকর্ণ, ভূশুণ্ডীর মাঠ, হনুমানের স্বপ্ন, ভারতের খনিজ, গল্পকল্প প্রভৃতি। তাঁর রচিত চলন্তিকা অভিধান বাংলা ভাষা শিক্ষার্থীদের কাছে অমূল্য সম্পদ। অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ 'একাদেমী’, ‘রবীন্দ্রপুরষ্কার' সহ বহু পুরষ্কার পান। ভারত সরকার থেকে ‘পদ্মভূষণ’লাভ করেন। ১৯৬০ সালের ২৭ এপ্রিল রাজশেখর বসুর মৃত্যু হয়।