বইটির ভূমিকা থেকে নেয়া: বিশ্ব এখন দ্রুত ও আকস্মিকভাবে মচকে যাওয়া পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় দুর্ভাগ্যজনকভাবে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যহত রাখার সংগ্রাম চলছে, সেগুলােয় উদ্দীপিত করার মত নানান প্যাকেজ সন্নিবেশিত করা হয়েছে আত্মবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনতে দেশসমূহকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে। এছাড়া পশ্চিমের ধনী দেশগুলাে বুঝতে পারছে তাদের প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক কমে গেছে, তাদের চিরকালের অর্থনৈতিক ক্ষমতা দ্রুত স্থানান্তরিত হয়ে পুব গােলার্ধে সরে আসতে শুরু করেছে এবং সে অঞ্চলের দেশসমূহের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। এসবের সাথে সবশেষে যােগ হয়েছে ওয়ার্ল্ড টেকনােলজি বা প্রযুক্তির মেকানিক্যাল থেকে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে - ইন্টারনেট, কম্পিউটার, সেল ফোন এবং সােশ্যাল মিডিয়া প্রভৃতিতে রূপান্তরিত হওয়া; যা নির্মাতা ও ক্রেতা, উভয়ের আচরণের ওপর গুরুতর প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলােসহ আর যে সমস্ত পরিবর্তন ঘটেছে, মার্কেটিংয়ের জন্য সেসব নিয়ে মাথা ঘামানাের প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে। মার্কেটিংয়ের কনসেপ্ট বা ধারণাকে ম্যাক্রোইকোনমিকসের ভারসাম্য রক্ষাকারী ধারণা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যখনই ম্যাক্রোইকোনমিক পরিবেশ বদলে যায়, তখন ক্রেতার মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটে এবং তা মার্কেটিংকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে নেতৃত্ব দেয়। গত ৬০ বছরে মার্কেটিং রূপান্তরিত হয়েছে প্রােডাক্ট-সেন্ট্রিক বা পণ্য-কেন্দ্রীক (মার্কেটিং 1.0) থেকে কনজিউমার-সেন্ট্রিক বা ক্রেতা-কেন্দ্রীকে (মার্কেটিং 2.0)। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি পরিবেশের নতুন গতিশীলতার সাথে তাল রেখে আরেকবার রূপান্তরিত হচ্ছে মার্কেটিং। আমরা দেখতে পাচ্ছি কোম্পানিগুলাে তাদের দৃষ্টি প্রসারিত করছে তাদের পণ্য থেকে ক্রেতা, ক্রেতা থেকে মানবজাতির ইসুতে। মার্কেটিং 3.0 হচ্ছে সেই স্তর, যেখানে কোম্পানিগুলাে হিউম্যান-সেন্ট্রিক বা মানবজাতি-কেন্দ্রীকতার দিকে ঝুঁকেছে এবং যেখানে মুনাফার ভারসাম্য রক্ষিত হয় কর্পোরেট বা মিলিত দায়িত্বশীলতার সাথে । এখনকার প্রতিযােগিতামূলক বিশ্বে কোম্পানিকে আমরা একমাত্র এবং স্বনির্ভর চালক বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখি না। দেখি কর্মচারী, পরিবেশক, ডিলার ও সরবরাহকারীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অনুগত নেটওয়ার্ক হিসেবে। যদি এই নেটওয়ার্কের অংশীদারদেরকে সতর্কতার সাথে বাছাই করা হয়, তাদের উদ্দেশ্য সমন্বিত এবং পারিতােষিক ন্যায়সঙ্গত ও উদ্বুদ্ধ করার মত হয়, তাহলে কোম্পানি ও তার অংশীদাররা মিলিতভাবে একটি শক্তিশালী প্রতিযােগীতে পরিণত হতে পারবে। এসব লক্ষ্য অর্জনে কোম্পানিকে অংশীদারদের সাথে তার মিশন (দায়িত্ব), ভিশন (রূপকল্প) ও ভ্যালু (মূল্যবােধ) সম্পর্কে আগেই বােঝাপড়া করে নিতে হবে যাতে তারা একযােগে লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারে। আমরা এই বইয়ে বর্ণনা করেছি একটা কোম্পানি কিভাবে তার উদ্দেশ্য, তার রূপকল্প ও মূল্যবোেধ নিজের বড় বড় সকল স্টেকহােল্ডার অংশীদারদের মধ্যে বাজারজাত করতে পারে। কোম্পানি নিজের ক্রেতা ও স্টেকহােল্ডার অংশীদারদের জন্য উঁচুদরের মূল্যবােধ সৃষ্টির মাধ্যমে মুনাফা করতে পারে। আমাদের আশা কোম্পানিগুলাে তার ক্রেতাদেরকে দেখবে নিজেদের কাজ শুরু করার কৌশলগত স্থান হিসেবে এবং তাদের চাহিদা, উদ্বেগ প্রভৃতির দিকে পুরােপুরি মনােনিবেশ করবে। এই বইয়ের কাঠামাে গড়ে উঠেছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের ওপর ভিত্তি করে। প্রথম অংশে আমরা ব্যবসার মূল ধারার সার সংগ্রহ করেছি যা মানবজাতি-কেন্দ্রীক মার্কেটিংয়ের অপরিহার্য বা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং মার্কেটিং 3.0-এর ভিত্তি স্থাপন করবে। দ্বিতীয় অংশে আমরা দেখিয়েছি কোম্পানি কিভাবে তার উদ্দেশ্য, রূপকল্প এবং তার গুরুত্বপূর্ণ সব স্টেকহােল্ডার, ক্রেতা, কর্মচারী, চ্যানেল বা মাধ্যম অংশীদার ও অন্যান্য স্টেকহােল্ডারদের মধ্যে বাজারজাত করতে পারে। তৃতীয় অংশে আমরা মার্কেটিং 3.0 বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা বিনিময় করেছি বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান নানান ইস্যু যেমন মানবকল্যাণ, দারিদ্র্য বিমােচন, পারিপার্শ্বিকতা ধরে রাখা ইত্যাদি নিয়ে। কর্পোরেশনগুলাে মানবজাতি-কেন্দ্রীক ব্যবসা পরিচালনার মডেল বাস্তবায়িত করতে পারে কীভাবে, সেসব নিয়ে। সবশেষ অংশে মার্কেটিং 3.0 সম্পর্কিত ১০ টি গুরুত্বপূর্ণ আইডিয়ার সার সংক্ষেপ নির্বাচিত কোম্পানির উদাহরণসহ তুলে ধরা হয়েছে যেগুলােকে তারা নিজেদের ব্যবসার মডেলে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
ফিলিপ কোটলার (ইংরেজি: Philip Kotler) (জন্ম: ২৭ মে, ১৯৩১) শিকাগোতে জন্মগ্রহণকারী একজন মার্কিন বিপণন বিশেষজ্ঞ। তিনি মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট বই ছাড়াও আরও বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক। তিনি এস.সি. জনসন এবং নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলোগ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর। বিশ্বব্যাপী করপোরেট জগতে ড. ফিলিপকে মার্কেটিং জনক হিসেবে সম্মান করা হয়। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর ড. ফিলিপ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ পর্যন্ত ১২টি সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন তিনি। ১৯৯৮ সাল থেকেই প্রফেসর কোটলার বিশ্বের সেরা ৫০ জন ব্যবসায় ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যতম।