"দেবদাস" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ ‘দেবদাস' (১৯১৭) শরৎচন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস। তা সত্ত্বেও ‘দেবদাস’ শরৎচন্দ্রের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নয়। এর মধ্যে ভাবপ্রবণতার যথেষ্ট পরিচয় রয়েছে। তব দেবদাসের মধ্যেই শরৎ প্রতিভার বৈশিষ্ট্যের ছাপ রয়ে গেছে। ছেলেবেলায় দেবদাস ও পার্বতী একই পাঠশালায় পড়ত। তখন থেকেই তাদের মধ্যে গভীর ভালবাসার সঞ্চার হয়েছিল। এখানে উল্লেখ না করলেই নয় যে কথা তা হল, শরৎসাহিত্যে পাঠশালা বাগদেবীর পীঠস্থান হােক বা না হােক প্রেমের দেবতার প্রধান লীলাভূমি। এখানে রমার সঙ্গে রমেশের দেখা হয়, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তর গলায় বৈচিরমালা পরায়, পার্বতী দেবদাসকে পায়। যা হােক, গভীর ভালবাসা হওয়া সত্ত্বেও পার্বতী ও দেবদাসের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না—কারণ পার্বতীর চেয়ে দেবদাসের বংশগৌরব বেশি। কিন্তু পার্বতীর কাছে এইসব সামাজিক মান-মর্যাদার মূল্য কম। তাই তাে সে দেবদাসকে বলে বাপমায়ের অবাধ্য হতে। তাকে বিয়ে করতে। দেবদাস বলিল, “বাপমায়ের অবাধ্য হইব?’ পার্বতী উত্তর করিল, “দোষ কি?’ পার্বতীর মধ্যে একটা সাহস আছে যার তুলনা মেলে শুধু অভয়ার চরিত্রে। এই সাহসের জোরেই মনােরমার কথার উত্তরে সে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, “না নিতে এসেছিলাম। এখানে আপনার লোক ত কেউ নাই।' মনােরমা অবাক হইল। কহিল, “বলিস কি? লজ্জা করত না?’ ‘লজ্জা আবার কাকে? নিজের জিনিষ নিজে নিয়ে যাব তাতে লজ্জা কি? পার্বতীর এই সাহস ছিল, নিজের জিনিসকে নিজের বলে দাবী করবার। আর এখানেই পার্বতীর স্বাতন্ত্র। পার্বতী এই উপন্যাসে সর্বংসহা বাঙালি নারীর চিরায়ত প্রতিমূর্তি। প্রেমের ফসল পরিণতির জন্যে তার আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াসের কোনাে কমতি নেই। কিন্তু যখন ব্যর্থতা তাকে প্রবলভাবে গ্রাস করলাে, তখন সে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নীরবে মেনে নিতেও দ্বিধা করে নি। বৃদ্ধ ভুবন চৌধুরীকে বিয়ে করতেও তাই সে বিন্দুমাত্র উৎসাহ কিংবা অনুযােগ প্রকাশ করে নি। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে স্বামী ও পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে থাকলেও তার হৃদয়ের গভীরে সবসময় বিরাজ করেছে দেবদাদা। দেবদাস উপন্যাসের শাখা-কাহিনী চন্দ্রমুখী উপাখ্যান। দেবদাসের চারিত্রিক মহিমা এবং তার বিপন্নতা প্রকাশের জন্যে চন্দ্রমুখীর উপস্থিতি উপন্যাসে একান্তই জরুরি ছিল। চন্দ্রমুখী এ উপন্যাসে বিড়ম্বিত নারীদের এক জীবন্ত প্রতিবাদ। তার সত্যি কথা বলার সৎ সাহস ছিল, ছিল প্রেম ও মমতা। তাই তাে দেখি, দেবদাসের চরম মানসিক বিপন্নতার সময়ে চন্দ্রমুখী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ব্যর্থতার যন্ত্রণা ভুলতে গিয়ে দেবদাস যখন মদে আসক্ত হয়ে আশ্রয় খুঁজেছে চন্দ্রমুখীর অন্ধকার গৃহকোণে, তখন চন্দ্রমুখী পরম মমতায় ও ভালবাসায় তাকে আশ্রয় দিয়েছে, ভালবেসেছে নিঃস্বার্থভাবে। আর সেজন্যেই আমাদের নির্দ্বিধায় বলতে হয়, চন্দ্রমুখী বারবণিতা হলেও মানবিক হৃদয়ানুভূতিতে সে সামাজিক কোনাে নারীর তুলনায় ছােট নয়। তালসােনাপুরের জমিদার নারায়ণ মুখুয্যের ছেলে দেবদাসের ব্যর্থ প্রেম নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘দেবদাস' উপন্যাসের কাহিনী। এ উপন্যাসের নায়ক দেবদাস। পার্বতীর সঙ্গে কৈশােরে যে ভালবাসা গড়ে উঠেছিল, যৌবনে সে ভালবাসার ব্যর্থতা-যন্ত্রণা থেকে দেবদাসের জীবন-অসঙ্গতি এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য। ভাল মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার সব সম্ভাবনা দেবদাসের মধ্যে থাকলেও, প্রেমের ব্যর্থতায় সে হয়ে পড়ে অন্ধকার জগতের নষ্ট মানুষ। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নিরাশ্রিত ও নিঃসঙ্গ মানুষের যে ছবি চিত্রিত হয়েছে, দেবদাসের জীবনেও আমরা সে নিরাশ্রয়তা ও নিঃসঙ্গতার সংক্রমণ লক্ষ্য করি। প্রেম-বিচ্ছিন্নতাই তার জীবনে উপ্ত করেছে নিরাশ্রয়তা ও নিঃসঙ্গতার বীজ। মানুষের জীবনে নিরাশ্রয়তা, নিঃসঙ্গতা ও অসঙ্গতির যে কুষ্ট-ছোঁয়া দেখি, শরৎচন্দ্রের দেবদাস বৃহৎ অর্থে তাদেরই পূর্বপুরুষ। প্রেমের ব্যর্থতা, শত-সম্ভাবনা সত্ত্বেও দেবদাসকে সমাজের সঙ্গে বেমানান মানুষে পরিণত করেছে; যার পরিণতিতে জীবনের সুর আর সঙ্গতি থেকে ঘটেছে তার বিচ্যুতি। কিন্তু জীবনের সুর ও সঙ্গতি থেকে বিচ্যুতি ঘটলেও, মনুষ্যত্ববােধ সে একেবারে বিসর্জন দিতে পারে নি। পিতার মৃত্যুর পর জমিদারী ভাগাভাগির প্রসঙ্গে ভাই দ্বিজদাসের সার্থবাদী চিন্তার পরিবর্তে দেবদাসের দায়িতশীল সিদ্ধান্তই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। অর্থনৈতিক দুরবস্থার সময়েও চন্দমখীকে অ সাহায্য করতে দেখি দেবদাসকে। মদ সে খেয়েছে সত্যি কিন্তু মদে তাকে কখনাে মাতাল করতে পারে নি। বস্তুত দেবদাসের মনে সব সময়ই জাগরূক ছিল পার্বতীর স্মৃতি। পার্বতীকে, সে কখনােই ভুলতে পারে নি। আর ভুলতে পারে নি বলেই ব্যর্থতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সে মদে আসক্ত হয়েছে। চন্দ্রমুখীর দ্বারস্থ হয়েছে একটু শান্তির অন্বেষায়। কিন্ত শান্তি তার নাগালের বাইরেই থেকে যায়। নিরাশ প্রেমের তাড়নায় নির্লজ্জ উচ্ছলতা-স্রোতে ভেসে গিয়ে ঘৃণিত ও শােচনীয় মৃত্যুকে বরণ করে নেয় সে। আর সে জন্যেই পাঠকের মনের সম্পূর্ণ সহানুভূতি দেবদাসের প্রতিই বর্ষিত হয়। শরৎচন্দ্রের প্রথম বয়সের রচনার মধ্যে দেবদাস উপন্যাসটি সর্বশ্রেষ্ঠ। এ উপন্যাসেই তাঁর প্রতিভার আভাস পরিলক্ষিত হয়। যদিও তার বিকাশ হয় নি। শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসের মতাে এ উপন্যাসেরও প্রধান লক্ষ্য চরিত্র সৃষ্টি। আখ্যায়িকা চরিত্র সৃষ্টির বাহন হিসেবেই উদ্ভাবিত। মানুষের মনের বিচিত্রিতা প্রকাশ করতেই তিনি এর কাহিনীসূত্র গেঁথেছেন। কিন্তু উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার করলে দেখা যায়, তিনি চরিত্র সৃষ্টির উপযােগী কাহিনী উদ্ভাবনে ব্যর্থ; আর এই ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা ও ভাবাতিশয্যপূর্ণ বক্তৃতার অবতারণা করেছেন অনেক জায়গায়। চন্দ্রমুখী সম্পর্কিত কাহিনীই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারপরও বলতে হয়, এ উপন্যাসের প্লট সরল; উপন্যাসের বিকাশও ঘটেছে সরল, একমুখী ও একরৈখিকভাবে। দেবদাসের কাহিনী বর্ণনায় আছে মােহনীয় যাদু, এর ভাষায় আছে কবিতার লাবণ্য, যা তীব্র আকর্ষণে পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে। আবেগপ্রবণ বাঙালি পাঠকমাত্রই দেবদাস উপন্যাসটি পড়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। দেবদাস’-এর সার্থকতা এখানেই আর এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।