"শেষের কবিতা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ শেষের কবিতা (১৯৩০) সময়-সুষমা ও কবিত্বমণ্ডিত বিশ্লেষণশক্তির দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী উপন্যাসগুলাের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। বিষয়ের ঐক্য ও আলােচনার সমগ্রতায়, অবান্তর বস্তুর প্রায় সম্পূর্ণ বর্জনে এ উপন্যাসটি অন্যান্য উপন্যাস থেকে উৎকর্ষ লাভ করেছে। অমিত ও লাবণ্যের প্রণয়-কাহিনী অনন্য সাধারণতার দিক দিয়ে অতুলনীয়। অমিতের চরিত্রে যে একটা সদাচঞ্চল, প্রথা-বন্ধন-মুক্ত, বিচিত্র-লীলায়িত প্রাণ-হিল্লোল আছে, তাই-ই তার সমস্ত চিন্তাভাবনা ও কর্ম-প্রচেষ্টাকে এমন একটা নৃত্যশীল গতিবেগ দিয়েছে যা আমাদের পদাতিক জীবনযাত্রার সঙ্গে কোনােমতেই মেলে না। মানুষের এই প্রথাবদ্ধ, পদাতিক জীবনের যান্ত্রিক গতির মধ্যে প্রেম যেন এক বিচিত্র ছন্দের নূপুর নিক্বণ। জীবনে প্রেমের প্রথম আবির্ভাব বসন্তবায়ুর মতাে হৃদয়কে ফুলে ফুলে ভরে তােলে। শেষের কবিতা’য় এটাই অমিত ও লাবণ্যের ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত ও প্রত্যক্ষ হয়ে বাস্তব জগতের রূপ ও স্পষ্টতা লাভ করেছে। প্রেমের জল-স্থল-আকাশ-বিকীর্ণ সর্বব্যাপী ইঙ্গিত; এর বিদ্যুৎ-শিখার মতাে উজ্জ্বল আকস্মিক ও সুদূরপ্রসারী বিস্তার; এর উদ্বেলিত আনন্দ-সাগর থেকে নতুন নতুন খেয়ালী কল্পনার ঢেউ; বাস্তব-বিদ্রুপশীল, ঊর্ধ্বপক্ষ আকাশ-বিহার; গভীর সর্বাঙ্গীণ সার্থকতা ও মুহূর্ত পরের ক্লান্তি ও অবসাদ; এর সূক্ষ্ম তৃপ্তিহীন অভাব-বােধ ও মিলনপথের অতর্কিত অন্তরায়; সর্বোপরি প্রেমের গূঢ়-নিয়ম-নিয়ন্ত্রিত, অথচ অভাবনীয় শেষপরিণতির চমকপ্রদ অসংগতি—প্রেমের এই সমস্ত রহস্যময় বৈচিত্র্যই উপন্যাসে পূর্ণভাবে আলােচিত ও প্রতিবিম্বিত হয়েছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।