"সার্বজনীন নজরুল" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ কবি আবদুল হাই শিকদারের নজরুলচর্চা নিতান্তই প্রাণের দায়ে। এই প্রাণের জন্য যেমন চাই আলাে, বাতাস, পানি ও খাদ্য তেমনি চাই কাজী নজরুল ইসলামকে। নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ অসম্পূর্ণ এবং উত্থান রহিত। এজন্যই আবদুল হাই শিকদার শুধু তত্ত্ব নয়, তত্ত্বের কচকচানি নয়, হাত বাড়ান দৃশ্যমানতার দিকে, প্রয়ােগের দিকে। এই কারণেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা এবং অক্লান্ত। নজরুলকে নিয়ে তাঁর কবিতীর্থ চুরুলিয়া জাতীয় কবির জন্মস্থানের ওপর প্রকাশিত এ দেশের প্রথম বই। পাঠক আতিথ্য পেয়ে যায় অনায়াসে। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘তােমার চরণ স্মরণ চিহ্ন: বাংলাদেশে নজরুল নজরুলের বংলাদেশ’ তাে এক অনন্য উদঘাটন, অনবদ্য যােজনা। এ বিষয়ের ওপর এই গ্রন্থ পথিকৃতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে চিরকাল। এর বাইরে ছড়িয়ে আছে তার নজরুলচর্চার আরেক আকাশ। এন্তার মূল্যবান, তীব্র-তীক্ষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও প্রতিবেদন লিখেছেন তিনি। তথ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে জাতীয় কবির স্মৃতি জড়িত স্থান ও স্থাপনাগুলােকে প্রাত্যহিক জীবনের কাছে নিয়ে এসে সচল ও সক্রিয় করে তুলেছেন। আদি। গ্রামােফোন রেকর্ড থেকে ধারণকৃত নজরুলের সান্নিধ্যে ধন্য শিল্পীদের কণ্ঠে গীত নজরুল সঙ্গীতের সিডি প্রকাশ করে তিনি অচলায়তনের দুয়ার খুলে দিয়েছেন। তারই প্রচেষ্টায় বাংলা একাডেমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল স্মৃতি। কক্ষ’ ও ‘নজরুল মঞ্চ'। চট্টগ্রাম শহরে গড়ে ওঠা নজরুল স্কোয়ার তারই প্রাণান্ত প্রয়াসের ফল। নজরুল ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে নজরুল সঙ্গীত সমগ্র প্রকাশ করে তিনি সমাজের কাছে, কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। নজরুলের জন্য দেশ ও বিশ্ব জুড়ে আজ যে পিপাসা আমরা দেখছি, দেখে প্রতিনিয়ত হচ্ছি আলােড়িত, গর্বিত; তারই খানিকটা জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই সার্বজনীন নজরুল।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।