"ইছামতি" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: ইছামতী' উপন্যাস রচনার জন্য বিভূতিভূষণ অনেক কাল ধরিয়া প্রস্তুতও হইতেছিলেন। ত্রিশ দশকের গােড়া হইতেই তিনি ইছামতী’ উপন্যাস রচনার উপকরণ সংগ্রহ শুরু করেন। ১৯৪৪ খৃষ্টাব্দ হইতে তিনি মােল্লাহাটি এবং তৎ-পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইছামতী’র পটভূমি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য ঘোরাঘুরি করেন। ১৯৪৬ সালের পুরা গ্রীষ্মকাল তিনি ইছামতী' উপন্যাস রচনার উপকরণ সংগ্রহে ব্যাপৃত থাকেন। বিভূতিভূষণের দিনলিপিতেও অনেক জায়গায় এ বিষয়ের উল্লেখ আছে ? ‘পথের পাঁচালী’ লেখার সময় হইতেই যে বিভূতিভূষণ ইছামতী’ রচনার পরিকল্পনা করিয়াছিলেন, সে বিষয়ে স্মৃতির রেখা’তে নিম্নরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় ? ‘কলবলিয়াতে স্নান করতে এলাম। ঠাণ্ডা জলে নাইতে নাইতে ভাবছিলাম—ঐ আমাদের গ্রামের ইছামতী নদী। আমি একটা ছবি বেশ মনে করতে পারি—এই রকম ধূ ধূ বালিয়াড়ী, পাহাড় নয়, শান্ত, ছােট, স্নিগ্ধ ইছামতীর দু’পাড় ভ’রে ঝােপে ঝােপে কত বনকুসুম, কত ফুলে ভরা ঘেঁটুবন, গাছপালা, গাঙশালিকের বাসা, সবুজ তৃণাচ্ছাদিত মাঠ। গায়ে গায়ে গ্রামের ঘাট, আকন্দ ফুল। গত পাঁচশত বৎসর ধরে কত ফুল ঝরে পড়ছে—কত পাখী কত বনঝােপ আসছে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ পাটা-শেওলার গন্ধ বার হয়, জেলেরা জাল ফেলে, ধারে ধারে কত গৃহস্থের বাড়ী। কত হাসি-কান্নার মেলা। অঞ্জ পাঁচশত বছর ধরে কত গৃহস্থ এল, কত হাসিমুখ শিশু প্রথম মায়ের সঙ্গে নাইতে এল--কত বৎসর পরে বৃদ্ধাবস্থায় তার শ্মশানশয্যা হ’ল ঐ ঠাণ্ডা জলের কিনারাতেই, ঐ বাঁশবনের ঘাটের নীচেই। কত কত মা, কত ছেলে, কত তরুণ তরুণী সময়ের পাষাণবয়ঁ বেয়ে এসেছে গিয়েছে মহাকালের বীথিপথ বেয়ে। ঐ শান্ত নদীর ধারে ঐ আকন্দ ফুল, ঐ পাটা শেওলা, বনঝােপ, ছাতিম বন। এই পল্লীগ্রামের যে জীবনযাত্রা, শতাব্দীর পর শতাব্দী এই রকম, এই বাঁশ শিমূল বনে অপরাজেয় শােভা এমনি ধারা দেখা যায়—ঝিঙে ক্ষেতে এমনি ফুল ফোটে—কত বনসিমতলার ঘাট, কত গ্রাম্য মেয়ে, কত হাসি কান্না প্রেম বিরহ-—এই রকম চলবে। এদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবাে আজ মাথায় এসেছে...মহাকাল যেন এই উপন্যাসের পটভূমি--নায়ক নায়িকা গ্রাম্য নরনারী।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।