"মিয়াজান দারোগার একরারনামা" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: বাংলা ভাষায় আত্মকথার সংখ্যা বিপুল। পুলিশ আত্মকথা লিখছে এটাও কোনাে নতুন কথা নয়। তাহলে মিয়াজানের একরারনামা কি আর একটা সংযােজন মাত্র ? বােধহয় না। একজন অশিক্ষিত মানুষের অকপট স্বীকারােক্তি এমন একটি সমাজের চলচ্ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে যা এর আগে আমরা কখনও শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। শিক্ষিত মানুষ মানেই লােকলজ্জায় ভীত, তাই আত্মকথা লিখতে বসেও তারা খুঁজে নেন নানা আড়াল-আবডাল। সম্ভবত মিয়াজানের জবানির সবথেকে জোরের জায়গা এটাই। শিক্ষার নাকাব না থাকায় সে অনায়াসেই বলতে পারে, তার বােন হলো কালেক্টর-সাহেবের রক্ষিতা। আর তাই সম্বন্ধীর সুপারিশে মাত্র বিশ বছর বয়সে শালাবাবু বনে যান পুলিশের দারােগা। মুরুব্বির ভূমিকাই দারােগার চাকরির একমাত্র শর্ত নয় জানাতে ভােলে না মিয়াজান। কারণ দারােগার মাস মাইনেটা খেয়ে থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতের খাসবেয়ারা। তার কথায়, বিচারক থেকে শুরু করে আমলা-মােক্তার-পুলিশ কর্মচারী, সাক্ষী- কে রিশবতখাের নয়? সমসাময়িক ক্যালকাটা রিভিয়ু বা হিন্দু প্যাট্রিয়টের সমালােচকেরাও এই ধোঁয়াশার থেকে মুক্ত নন। ১৮৬৯ সালে বইটি প্রকাশ পেলে তারা বলেন, ঘটনাগুলির কিছু সত্যতা থাকলেও সেসব ঘটেছিল তিরিশ বছর আগে। এখন ইংরেজ সুশাসনে ফারাক আসমানজমিন। সত্যিই কি তেমনটা ঘটেছিল? দুই শতাব্দী পরেও কি আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি তেমন কথা? পুলিশ হেফাজতে থার্ড ডিগ্রি ইস্তেমালের যে অনুপুঙ্খ ছবি মিয়াজানের জবানিতে উঠে আসে আর তার সাফাই হিসাবে মিয়াজান যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করে, একবিংশ শতাব্দীর পুলিশের মুখেও তাে আমরা শুনতে পাই সেই একই যুক্তির অনুরণন। গ্রাম বাংলায় নীলকর বনাম জমিদারদের। রােজকার কাজিয়া আর সেখানে পুলিশের ভূমিকা, ঐতিহাসিক নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটের থেকেও আমাদের বেশি করে মনে পড়িয়ে দেয় সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা। ১৮৬৯ সালে বইটি ছাপা হয়েছিল মাত্র ২০০ কপি। লেখক অজ্ঞাতপরিচয়। বইটি রাজরােষে পড়লেও বেশি সংখ্যক পাঠকের হাতে পৌছােয়নি। এইরকম একটি বইয়ের ১৪০ বছর পূর্তির লগ্নে পুনঃপ্রকাশ ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তাে বটেই, সেইসঙ্গে লড়াই আর পালটা লড়াইয়ের প্যাচপয়জারে ভরপুর কিত্সা পাঠকদের দেবে একটি ভালাে ক্রাইম কাহিনি পড়ার মৌতাত।