"জাপান যাত্রী" বইটি সম্পর্কে কিছু কথাঃ ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নােবেল পুরস্কার পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে নন্দিত হতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে আসে আমন্ত্রণ । এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রিত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে কারণে তাঁকে ঐ বছরই রওনা দিতে হয় আমেরিকায়। সে কারণে তিনি জাপানি জাহাজে রওনা দেন আমেরিকার পথে । এই যাওয়ার পথে তিনি জাপানে অবস্থান করেন তিন মাস। জাহাজে ওঠার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতে শুরু করেন। তবে রবীন্দ্রনাথের মতে ‘এ লেখা ধারাবাহিক চিঠিও না,প্রবন্ধও না । যা যখন মনে আসছে লিখে যাচ্ছি একবার revise করবারও চেষ্টা করি নি। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের লেখা এসব পত্র একবারে মূল লেখা এবং এগুলাের কোনাে সংশােধন করা হয় নি। ফলে এ লেখায় লেখকের ভ্রমণাভিজ্ঞতার অকৃত্রিম প্রতিচ্ছবিই প্রকাশ পায়। আবার ধারাবাহিকহীনতার যে কথা বলা হয়েছে তাও বোঝা যায় জাপান পৌছা পর্যন্ত নিয়মিত এবং জাপান পৌছার পর থেকে অনিয়মিত পত্র। তবু এসব পত্রের মধ্যে লেখকের ভ্রমণভিজ্ঞতা ও জাপান দর্শনের সম্যক অনুভূতি প্রকাশ পায়। পত্রগুলি ১৯১৬ সালে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ কিছু চিঠি হার্বার-মাস্টারের হাতে। এবং বাকিগুলাে সমুদ্রের মােহনায় নামার সময় পাইলটের মাধ্যমে পৌছানাের ব্যরস্থা করেন। যাই হােক, পরবর্তীতে বাংলা ১৩২৩ সনের শ্রাবণ মাসে (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) জাপান-যাত্রী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।