আমি আমার নয় পুরুষের নাম জানি। এঁদের আগমন সম্পর্কে যেটুকু জানি, আমাদের বাড়িতে একটা কুরসিনামা ছিলো। তা থেকে আমি জানি যে এঁরা বাইরে থেকে এসেছিলেন। এঁরা সব ধর্মপ্রচারক। দিল্লিতে এসেছিলেন। রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতনে এঁরা নানান দিকে ছড়িয়ে ছিটকে পড়েছেন। এঁদের মধ্যে ধর্মপ্রবণ একজন ভাটি অঞ্চলে চলে আসেন। এখানে থেকেছেন। এদেশের সাথে মিশে গেছেন।’—আল মাহমুদ একজন আল মাহমুদ যখন আত্মজীবনী লিখেন তখন একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসই লেখেন। যার প্রমাণ ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। গ্রন্থটি প্রথম যখন প্রকাশ হয় বোদ্ধাপাঠক মহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। কবিতা, গল্পের পর আত্মজীবনী রচনায়ও সাফল্য তার মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা আল মাহমুদের বহুদিনের। কিন্তু বয়স ও স্মৃতিশক্তির কারণে এখন আর তা সম্ভব নয়। ফলে দুটি গ্রন্থ মিলিয়েই একটি হয়তো মাহমুদের একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীর কাছাকাছি যাওয়া যাবে। কেননা ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’-তে মাহমুদের জীবন সমাজ ও বাস্তবতার যেসব অধ্যায় অনুপস্থিত ছিল ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ গ্রন্থে যেসব তো উঠে এসেছে। আল মাহমুদের কবিতা ও ফিকশন তৈরির ক্ষমতা সম্পর্কে পাঠকমাত্রই জ্ঞাত। হুঁশিয়ার পাঠকগণ মাহমুদের আত্মজীবনীতে এই ক্ষমতার ভিন্ন প্রয়োগ দেখে চমৎকৃত হবেন
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।