দারুস সালাম (আরবি: دار السلام "শান্তির নিবাস"; প্রাক্তন নাম এমজিজিমা) পূর্ব আফ্রিকার রাষ্ট্র তানজানিয়ার প্রাক্তন রাজধানী; এটি দেশটির বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনবহুল শহর। এটি একই সাথে দেশটির প্রধান বন্দর শহর এবং শিক্ষা, শিল্প ও অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। শহরটি তানজানিয়ার পূর্বভাগে ভারত মহাসাগরের সোয়াহিলি উপকূলে অবস্থিত। প্রশাসন ছাড়াও শহরটি তানজানিয়ার শিল্পকলা, পোশাকশৈলী, গণমাধ্যম, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র। দারুস সালাম শুধু একটি নগরী নয়, এটি তানজানিয়ার ৩১টি প্রশাসনিক অঞ্চলের মধ্যে একটি। এতে ৫টি পৌর জেলা আছে: উত্তরে কিনোন্দোনি, কেন্দ্রে ইলালা, দক্ষিণে উবোংগো ও তেমেকে এবং পূর্বে কুরাসিনি খাঁড়ির অপর পাড়ে কিগাম্বোনি জেলা। দারুস সালাম প্রশাসনিক অঞ্চলটিতে ২০১২ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ৪৪ লক্ষ লোকের বাস।:২ ২০২০ সাল নাগাদ এর জনসংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়িয়ে যাবে। এটি পূর্ব আফ্রিকার বৃহত্তম ও সমগ্র আফ্রিকার ৬ষ্ঠ বৃহত্তম পৌর অঞ্চল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধমান শহরগুলির একটি। এই শহরের জলবায়ু উষ্ম ও আর্দ্র; এখানে বাৎসরিক ১১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ১৮৬২ সালে জাঞ্জিবারের সুলতান তাঁর গ্রীষ্মকালীন নিবাস হিসেবে দারুস সালাম শহরটিকে প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় এখানে এমজিজিমা নামের একটি গ্রাম ছিল। এরপর বহুদিন শহরটি একটি ক্ষুদ্র সমুদ্র বন্দর ছিল। ১৮৮৭ সালে এখানে জার্মান পূর্ব আফ্রিকা কোম্পানি একটি বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে ও শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর থেকে শহরটির ভাগ্য পরিবর্তন হওয়া শুরু করে ও এর কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৯১ সালে এটি জার্মান পূর্ব আফ্রিকা উপনিবেশের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৯০৭ সালে এখান থেকে কেন্দ্রীয় রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ১৯১৮ সালে জার্মানি ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় বরণ করলে জার্মান পূর্ব আফ্রিকা উপনিবেশের পতন ঘটে। ১৯১৬ সালেই শহরটি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত তানগানিকা অঞ্চলের অংশে পরিণত হয়। ১৯৪০-এর দশক থেকে আধুনিক শহর হিসেবে শহরটির প্রবৃদ্ধির সূচনা ঘটে। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এটি স্বাধীন তানগানিকা রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। এরপর ১৯৬৪ সালে তানগানিকা ও জাঞ্জিবার একীভূত হয়ে তানজানিয়া রাষ্ট্র গঠন করলে শহরটি তানজানিয়ার রাজধানীতে পরিণত হয় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই মর্যাদা বজায় রাখে। ১৯৭৪ সালে তানজানিয়ার সরকার দোদোমা শহরকে তানজানিয়ার জাতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর পরে একাধিক দশক ধরে ধীরে ধীরে দোদোমাতে তানজানিয়ার জাতীয় সংসদ, তানজানিয়ার আইন প্রণয়ন সংস্থা ও অনেক সরকারী কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। তা সত্ত্বেও ২১শ শতকের প্রারম্ভে এসেও তানজানিয়ার সরকারী কর্মকাণ্ড ও কার্যালয়গুলি সম্পূর্ণভাবে দোদোমাতে স্থানান্তরিত হয়নি। দারুস সালামের ভবনগুলি শহরটির ঔপনিবেশিক অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে। এখানে বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর সমৃদ্ধ মিশ্রণ ঘটেছে, যাদের মধ্যে সোয়াহিলি, ব্রিটিশ, জার্মান ও এশীয় ঐতিহ্য বেশি চোখে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শহরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ ঘটে, ফলে অনেক আধুনিক বহুতলাবিশিষ্ট ভবনের পাশাপাশি একটি হাসপাতাল ভবনসমষ্টি, একটি কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র, এবং উচ্চ আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়। শিক্ষায়তনিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত), একাধিক গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র আছে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিভুকোনি মহাবিদ্যালয় (১৯৬১) এবং ব্যবসায় শিক্ষা মহাবিদ্যালয় (১৯৬৫) উল্লেখযোগ্য। এখানে তানজানিয়ার জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় মহাফেজখানা বা আর্কাইভ ও জাতীয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি অবস্থিত। জাদুঘরে পূর্ব আফ্রিকান জাতিবিদ্যা, প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা ও ইতিহাসের উপর অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ আছে। দারুস সালামের প্রধান ভাষা হল সোয়াহিলি ভাষা; এটি বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনবহুল সোয়াহিলিভাষী নগরী। দারুস সালাম শহরের শিল্পকারখানাগুলিতে সাবান, রঙ, সিগারেট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য, ধাতু ও কাচের সামগ্রী, বস্ত্র ও পোশাক, কাঠের খোদাইকর্ম ও জুতা প্রস্তুত করা হয় এবং পেট্রোলিয়াম পরিশোধন করা হয়। দারুস সালাম বন্দরের প্রাকৃতিক ও প্রায় সম্পূর্ণ স্থলবেষ্টিত পোতাশ্রয়টি মূল তানজানিয়া ভূখণ্ডের সিংহভাগ কৃষিজ ও খনিজ রপ্তানিদ্রব্য রপ্তানির কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও প্রতিবেশী রাষ্ট্র উগান্ডা, বুরুন্ডি, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, জাম্বিয়া ও মালাউই-র জন্যও দারুস সালাম বন্দরটি সেবা প্রদান করে। এখান থেকে কঙ্গো নদীর নাব্য উপনদী লুয়ালাবা পর্যন্ত একটি রেলপথ আছে, তাই এটি কঙ্গো নদীর একটি অতিক্রমণ বন্দর (transit port) হিসেবে কাজ করে। দারুস সালাম বন্দর থেকে স্বর্ণ, কফি, সিসাল গাছের আঁশ (দড়ি তৈরির জন্য), তুলা ও তামা (স্থলবেষ্টিত জাম্বিয়া থেকে আগত), ইত্যাদি দ্রব্য রপ্তানি করা হয়। দারুস সালাম শহর থেকে পশ্চিম দিকে তাঙ্গানিকা হ্রদের তীরবর্তী কিগোমা শহর পর্যন্ত ও উত্তর দিকে ভিক্টোরিয়া হ্রদের তীরবর্তী মোয়ানজা ও আরুশা শহর পর্যন্ত রেলপথ আছে। এছাড়া ১৯৭৫ সালে সম্পূর্ণকৃত তানজাম রেলপথের মাধ্যমে দারুস সালাম বন্দরটি জাম্বিয়ার সাথে সংযুক্ত। দারুস সালাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের বিমানসেবা প্রদান করে। ছবির মত সুন্দর পোতাশ্রয়, দৃষ্টিনন্দর বেলাভূমি ও প্রাণবন্ত নৈশজীবনের কারণে শহরটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। যেসব পর্যটক তানজানিয়াতে বেড়াতে আসেন, তাদের বেশির ভাগের জন্য দারুস সালাম দেশটির প্রধান প্রবেশপথ ও প্রস্থানপথ। এখান থেকে জাতীয় উদ্যানগুলি সফর করা (সাফারি) ছাড়াও উনগুজা ও পেম্বা দ্বীপগুলি ভ্রমণ করা যায়। খোলা আকাশের নিচে গ্রামীণ জাদুঘরে দারুস সালামের স্থানীয় ও দেশের অন্যান্য উপজাতিদের ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে এবং সেখানে উপজাতিক নৃত্যের আয়োজন করা হয়। জাতীয় জাদুঘরে তানজানিয়ার ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রদর্শনী ছাড়াও নৃবিজ্ঞানী লুই লিকি-র খুঁজে পাওয়া আদি মানবদের জীবাশ্ম রয়েছে। মোয়েঙ্গে কাষ্ঠভাস্করদের বাজারে কারিগর-শিল্পীরা মুখোশ, অস্থিভাস্কর্য, ঢাল, বল্লম, বস্ত্র ছাড়াও তিংগাতিংগা শৈলীর রঙে ভরপুর চিত্রকর্ম বিক্রি করে থাকে। পোতাশ্রয়ের উত্তর প্রান্তে কিভুকোনি মাছের বাজার সরগরম থাকে, যেখানে ভারতীয় মহাসাগরে বিচরণকারী "দাও" নামের পালতোলা নৌকাগুলি তাদের শিকার করা মাছ নিলামে বিক্রি করে। দাও নৌকায় করেই দারুস সালাম থেকে নিকটবর্তী বোঙ্গোইয়ো এবং এমবুদিয়া দ্বীপগুলিতে ঘুরে আসা যায়। দারুস সালাম সংরক্ষিত সামুদ্রিক অঞ্চলের অন্তর্গত এই দ্বীপগুলির জনবসতিহীন সব সৈকত আর পরিস্কার পানি পর্যটকদের কাছে প্রিয়। শহরের কিগাম্বোনি পৌরজেলাতেও শুভ্র বালির সৈকত আছে।