“সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা একাত্তরের ঘাতকদের জবান জুলুম ষড়যন্ত্র চিত্র" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ যুদ্ধের পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ থাকে; একপক্ষ অন্য পক্ষের বিরােধিতা করে। বিরােধিতা যে কেবল ভূমিতে, আকাশে, জলপথে মারণাস্ত্র নিয়ে লড়াই; তাই নয়, বিরােধিতার চূড়ান্ত পরিণামে যে সংঘর্ষ তাতে যেমন সামরিক কৌশল ব্যবহৃত হয়। একই সাথে রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং যােগাযোেগীয় কৌশলও ব্যবহৃত হয়। পুরাকাল থেকেই যােগাযােগ তথা গণমাধ্যম তাই যুদ্ধের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল পর্যন্ত এদেশে মােট ২৩টি দৈনিক পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ছিল বেতার এবং টেলিভিশনও। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রায় চব্বিশ বছর, অল্পকিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে এসকল গণমাধ্যম বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে সফল পরিণতিতে পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। কিন্তু ২৫শে মার্চ ১৯৭১ পাকবাহিনী ঢাকা আক্রমণের পর এসকল পত্রিকা সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। শুধু পত্রপত্রিকা নয়, পাকবাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরাে যােগাযােগ ব্যবস্থারই নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দেশের বাস্তব অবস্থা জানতে না দেয়া, তাদের নৃশংস তৎপরতা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ-আক্রমণ সম্পর্কে জনগণকে অনবহিত রাখা। তথ্য ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের আনুগত্য বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল- এদেশের মানুষের স্বাধীনতাবােধ ও আদর্শ, পাকিস্তানবােধ ও আদর্শ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা এবং এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাঠামাে ভেঙে ফেলা। কিন্তু তা ঘটেনি এবং ঘটা সম্ভবও ছিল না। অবরুদ্ধ দেশে মানুষই মানুষের কাছে খবর পৌছে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশেষ করে বেতার এসময় হয়ে ওঠে মানুষের তথ্য-চাহিদা পূরণের নির্ভরযােগ্য উপায়। তবে এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে দেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এসকল মাধ্যমে কর্মরত শব্দ-সৈনিকেরা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতাবােধ ও চেতনাকে সংহত ও শাণিত করে, দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশকে হানাদার মুক্ত করার প্রেরণা যােগায়। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পাক-সামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রচারযন্ত্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সফল ভূমিকা পালন করে এবং মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি ফ্রন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এদেশের মানুষ কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করেছিল অথবা তাদের মনে এই উত্তরণময় ঘটনাকালের কী ‘নির্মাণ হয়েছিল সেটি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। একথা সত্যি, যারা ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা, তাদেরকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সংজ্ঞায়িত করতে হয়েছিল এবং সেভাবেই তারা রণকৌশল স্থির করেছিলেন। সাধারণ বাঙালির কাছে মুক্তিযুদ্ধের মানে ছিল দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ রচনা, রক্ত দিয়ে, জীবন। দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করা। স্বাধীনতার প্রতীক তাদের কাছে তাই রক্তারুণ দিশ্বলয়ে উদয় উষার সূর্যরেখা। বাংলাদেশের নব জন্ম আজ ধ্রুব সত্য। রক্তারুণ দিগ্বলয়ে কাঁপছে উদয়-ঊষার সূর্যরেখা। বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গে যে-নবজন্মের আর্তি, তার দিগন্ত-প্রকম্পিত শব্দমালা আজ বাঙালির কণ্ঠে। শিশুঘাতী, নারীঘাতী বর্বরতার প্রতিরােধে এমন সম্মিলিত সংগ্রামের ইতিহাস নিজের বুকের রক্তে বাঙালি এমন করে আগে কোনদিন লেখেনি। অহিংস গণঅসহযােগ থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, সংসদীয় গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতার রক্ত-পতাকা উত্তোলন- বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে এমন ঘটনা অকল্পনীয়, অভাবনীয়। এই অকল্পনীয়, অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।