ঘুণে ধরা সমাজের বাস্তব চিত্র ‘এক ঝুড়ি গল্প’। ১৮টি ঝরঝরে গল্প দিয়ে কবি ও গল্পকার প্রদীপ কুমার কর্মকার সাজিয়েছেন ‘এক ঝুড়ি গল্প’। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। গ্রন্থের ১৮টি গল্পের কাহিনি অনবদ্য। দৃশ্যপট, বর্ণনাভঙ্গির সরল প্রথার গল্প পরিবেশনায় তার রয়েছে যথেষ্ট মুনশিয়ানা। পাঠক, আসুন গল্পগুলোর একে একে পোস্টমর্টেমের নথি খুলতে শুরু করি- অসহনীয় সুখ : কেন্দ্রীয় চরিত্র কাবেরী। স্বামী নিগৃহীত অবস্থায় পরিবারের হাল ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়ে সুখের সায়রে সবাইকে নাইয়ে শেষে চলে গেলেন পরপারে। সুখ যেমন কাবেরীর কপালে সইল না, তেমনি আমাদের কাছে তার সফলতাকেও ‘অসহনীয় সুখ’ বলে মনে হয়েছে। নামকরণ যথার্থ। ফেসবুক : দার্শনিক বাক্য- ‘এ পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর জায়গা, এখানে কেউ কারো নয়।’ কলেজ শিক্ষক রহমান তার ফেসবুকের উড়নচণ্ডী বন্ধু ডালিয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করে প্রতারিত হয়েছেন। গল্পটা বাস্তব এক আয়না যেন চলমান সময়ের। নক্ষত্রের অপমৃত্যু : ‘পুড়ে গেল, পুড়ে গেল ভাইজান বাঁচান।’ - না, শেষ পর্যন্ত কুখ্যাত ইব্রাহিমের এসিড সন্ত্রাসের নির্মম শিকার কাজল নামের মেয়েটার মৃত্যু হয়। আহা! মেয়েটি বড় কোমল আর মেধাবী ছিল। অতৃপ্ত আত্মা : রোকনুজ্জামানের অতৃপ্ত আত্মা ফেরার হতে চায়। ছোট্ট পুষ্পিতাকে নিয়ে তাই সে দেশ ছেড়েছে। সত্যি! শিউলির মতো এক পুরুষে অতৃপ্ত নারীরা সন্তান পরিত্যাগ করতেও চিন্তা করে না। আজকাল তো সংবাদপত্রে এমনটাই পড়ি। বিবর্ণ বসন্ত : গল্পটি ইন্দ্রনীলের জীবনের কষ্টকর অধ্যায়ের কথা। পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে ধনীর দুলালি নন্দিতা তাকে পরিত্যাগ করে। হায় প্রেম! জীবন কি এতই তুচ্ছ? দুঃখিনী মাতা : উগ্র আধুনিকা এক মায়ের মেয়ে তানিয়াকে ভালোবেসেছে বিনম্র শিক্ষিকার এক বিনয়ী ছেলে সোহেল। এ নিয়ে দুই মা মুখোমুখি। অবশেষে জয়ী হন সোহেলের মা। তার মা যে এক বিধবা ‘দুঃখিনী মাতা’। বৈধব্য : ‘বৈধব্য জীবন বড়ই কষ্টের’! লাবণীর বৈধব্য জীবনের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে ‘বৈধব্য’ গল্পে। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ : জীবনের প্রথম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণেই ব্যর্থ হয়েছে মনির। তাইতো সহেলী নামের মেয়েটি উড়ে চলে যায় মেঘ কিংবা পাখি হয়ে- দূরে, বহুদূরে। বষর্ণমুখর বিকেল : এক গায়িকা কল্যাণীর জীবনে অভিশপ্ত অমানিশারূপে সর্বস্ব লুটে নেয় লম্পট ওস্তাদ জটিলেশ্বর। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এই জটিলেশ্বর বাবাদের লোলুপ থাবা থেকে আমাদের মেয়েরা কবে নিষ্কৃতি পাবে? বিশাখা-বিপাশা : পিঠেপিঠি দুই বোন। বোনে বোনে এত মিল! গল্পে উঠে এসেছে বৃদ্ধ নানাকে ভালোবাসার অনাবিল আনন্দ চিত্র। আহা! পরিবারের এই অটুট বন্ধন এখন টিকে থাকে না কেন? বড় চাচা : নিঃসন্তান বড় চাচা শান্তিপ্রিয় মানুষ। ঝগড়াটে ভাইয়ের ছেলে সোহাগ তার কাছে সন্তানতুল্য। একদিন সোহাগ বড় চাচাকে বলে, ‘আমি কেন তোমারই ছেলে হলাম না?’ সোহাগ, তুমি জানো না- জন্মদাতা না হয়েও পিতামাতা হওয়া যায়। বড় চাচা তেমনই একজন মহান পিতা। সাইদুরের মুক্তি : বিয়ের পাঁচ বছরেও শেলীর সন্তান না নেওয়ার রহস্য উদ্ঘাটন করে ‘সাইদুরের মুক্তি’ মেলে। সাইদুর জানতে পারে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে তাকে হারাতে হয় মা হওয়ার ক্ষমতা। অবশেষে শেলী পালিয়ে যায় সাইদুরকে নির্যাতন মামলা দিয়ে। সাইদুর তাকেই মুক্তি ভাবে। স্মৃতির বাসর : স্মৃতির বাসরে শফিক ভাবে দুই বোন নাঈমা ও সালমাকে ভালোবাসার কথা। দুই মেয়ের কাÐ দেখে ওদের মা শফিককে সরে যেতে বলে। সঠিক সিদ্ধান্ত। এটাই সভ্যতা। অশান্তির চাদর : জন্মগত আচরণ সমস্যা নিয়ে পবিত্র শেষ পর্যন্ত মাদকসেবী হয়ে পুরো পরিবারকে ‘অশান্তির চাদর’ নয়- কাফনে মুড়ে দেয়। ভাই হয় দেশান্তর, বাবার হয় মৃত্যু আর মা হন শয্যাশায়ী। আত্মাহুতি : বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর বউদির শরীরের দখল নিতে চায় লম্পট মেজো ভাই। প্রতিবাদী বিনয়ী ছোট ভাই সুবিনয় বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ দেয়। তার এই ‘আত্মাহুতি’ সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক! নিরাপদ আশ্রয় : রাহেলা অপয়া। বিমাতার অভিযোগ- সে নাকি তার মাকে খেয়েছে। ফলে তিন সতিনের স্বামী কুদ্দুসের ঘরে ওঠে রাহেলা। হঠাৎ কুদ্দুসও অক্কা পায়। বাবার বাড়ি ফিরে এলে বিমাতা তাকে অপয়া বলে নিগৃহীত করে। শহরে এসে রাহেলা এক লেখকের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় পায়। লেখক তাকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে চান। ভালো কাজ : ঝুড়ির শেষ গল্প ‘ভালো কাজ’। ভালো কাজই বটে।- গল্পের নায়ক তার ছোটবেলার সাথি গণধর্ষিতা সেতুকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করার মহৎ সিদ্ধান্ত নেয়। এই হলো ১৮টি গল্পের একটা পরিপূর্ণ ঝুড়ি। ঝুড়িটি তলাবিহীন, সমাজ ছাড়া নয়। ঝুড়ির প্রতিটি গল্পই আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের বাস্তব চিত্র। স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সাহিত্যদেশ বেশ যতœ নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছে। কাব্য কারিমের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ১৩৫ টাকা মাত্র।
কবি প্রদীপ কুমার কর্মকার লেখালেখি করছেন দুই যুগেরও অধিককাল ধরে। প্রচারবিমূখ বলেই তিনি বই প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না। শুভাকাক্সিক্ষদের প্রেরণায় প্রথম কবিতার বই ‘উচ্ছ্বসিত নদী’ প্রকাশিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-তে। ছোটগল্পের বই ‘এক ঝুড়ি গল্প’ প্রকাশিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে। এবার প্রকাশিত হল উপন্যাস ‘কপোত কপোতি’। তার রচিত কবিতা, ছোটগল্প বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক গুণের অধিকারী এই লেখকের জন্ম ১৯৬০ সালের ১৩ মার্চ পটুয়াখালী সদর উপজেলার নতুন বাজার, চরপাড়ায়। পিতা শ্রী নরেন্দ্র লাল কর্মকার এবং মাতা শ্রীমতি যমুনা বালা কর্মকার। কবি প্রদীপ কুমার কর্মকার মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এক্টোপ্যারাসাইট শাখা) হিসেবে প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান-ঢাকায় কর্মরত। একজন প্রকৃত পেশাজীবী ও সংগঠক হিসেবে তার খ্যাতি ও সুনাম রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ বেতারের বিশেষ গ্রেডের শিল্পী। বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার-ঢাকার নিয়মিত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী। ১৯৮৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতারের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল বেতারে সংগীত পরিবেশন করে আসছেন। এছাড়াও তিনি ‘কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন-বাংলাদেশ’ ভোলা জেলা শাখায় পরপর দুইবার সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ‘বিসিএস লাইভস্টক অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘বাংলাদেশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন’র একজন সক্রিয় কর্মী। লেখালেখি, পেশাগত ও সামাজিক কল্যাণে তার সংশ্লিষ্টতা অনুকরণীয়।