রবীন্দ্র সঙ্গীত সুষমা ভূমিকা কিছু কিছু ব্যক্তির জীবন জাতীয় জীবনের বহুমুখিন সৃষ্টিধারার সঙ্গে এমন গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে তাঁদের কর্মকৃতিকে বিস্মৃত হলে জাতীয় জীবনের ইতিহাসের ধারা বিস্মৃত হবার নামান্তর হয়ে পড়ে। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত—এই তিন পুরুষের যে মহতী সৃষ্টিধারা প্রবাহিত হয়েছিল তা বাংলার নব জাগরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সঙ্গীতজগতে রামমোহন যে ধ্রুপদ-গানের প্রবর্তন করলেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর সন্তানেরা—দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ—সেই ধারাকে নানা দিক থেকে নানা ভাবে পুষ্ট তো করলেনই, নানা নতুন সুর সৃষ্টির দ্বারা সেই ধারাকে সমৃদ্ধশালিনী করে তুললেন। তাঁদের এই সৃষ্টিপ্রয়াসের ইতিহাস অনেক বাঙালি জানেন না;—শ্রীযুক্ত কিরণশশী দে এই অভাবটি পূরণ করে না-জানার লজ্জা থেকে আমাদের ত্রাণ করেছেন। সকল রকমের সঙ্গীতেই স্বরলিপির প্রয়োজনীয়তা সে সুর-বিকৃতি করবার জন্যে নয়, সুর-রচয়িতার সুরগুলিকে অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যে—সেই বিষয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের এবং তৎসহ কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে প্রমুখ বিশিষ্ট সঙ্গীতবেত্তাদের যথাযথ উদ্ধৃতি সংকলন করে কিরণশশীবাবু এই পুস্তিকাটিতে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। গানের কথাগুলি কীভাবে উচ্চারণ করা দরকার- সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ও অভিমত ছিল খুবই সুস্পষ্ট। জড়িয়ে-জড়িয়ে শব্দের উচ্চারণ কিংবা অস্পষ্ট উচ্চারণ শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন অতীতের সঙ্গীতাচার্যেরা গায়কের দোষ বলে নির্ণীত করেছেন। অধুনা যে-ভাবে অস্ফুট কাকলীর ঢঙে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া হয়ে থাকে তা বেদনাদায়ক। এই সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মতামত সকলের কাছে তুলে ধরে কিরণশশীবাবু সঙ্গীতসাধকদের প্রভূত উপকার করেছেন। এই পুস্তিকায় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট বিভিন্ন সুর ও তাল তাঁর সঙ্গীতে স্বদেশ-প্রীতি প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এই সকল মূল্যবান আলোচনা রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিক্ষার্থীদের নিঃসন্দেহে উপকারে আসবে। বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদু ভট্ট ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি সঙ্গীতাচার্যদের জীবন ও সাধনা সম্বন্ধে অতি মূল্যবান তথ্য কিরণশশীবাবুর এই বইটিতে পাওয়া যাবে।