মহান আল্লাহ তাআলা ইসলামের খেদমতের জন্য হজরত হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দিদুল মিল্লাত শাহ আশরাফ আলি থানবি রহ.-কে যে তাওফিক দান করেছেন সে সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। তিনি যখন মুসলমানদের অবস্থা দেখলেন যে, ভুলে যাওয়া, অবহেলা এবং অমনোযোগিতার কারণে ইসলামি শরিয়তের অনেক বিষয়াদি পরিত্যাজ্য এবং দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। তখন তিনি আল্লাহ তাআলার রহমতে দীনকে পরিমার্জন এবং পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দীনের পুনঃসংস্করণ, দীনের বিভিন্ন দিক এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মুসলমানদের সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার জন্য স্বীয় কলম মোবারক চালু করেন। অন্যান্য সংস্কারের মতো সমাজ সংস্কারও তাঁর আলোচনা এবং লেখনীর এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল। এই প্রয়োজনকে সামনে রেখে সামাজিক কুসংস্কার ও অসঙ্গতি দূর করার লক্ষ্যে ‘আদাবুল মুআশারাত’ নামক কিতাবটি রচনা করে তিনি এই অতীব প্রয়োজন পূরণ করেন। যাতে বিভিন্ন সামাজিক বিষয়াদি যেমন, সালাম-কালাম, সাক্ষাত, সেবা-শুশ্রƒষা, চিঠিপত্র, আতিথেয়তা ও মেহমানদারি, সমাবেশ ও অনুষ্ঠান, লেনদেন, হাদিয়া, সুপারিশ, শিক্ষা-দীক্ষা, উস্তাদ ও পিতা-মাতা এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়াদির ব্যাপারে ইসলামি বিধি-বিধানকে সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। হজরত মাওলানা নাসিরুদ্দিন সাহেব কিতাবটিকে অধ্যায় আকারে সুবিন্যস্ত করেছেন। সেই সাথে হজরত থানবি রহ. এর বিভিন্ন ওয়াজ এবং মালফুজাত হতে আরও অনেক বিষয় সংযোজন করেছেন। সুতরাং বলা যায় যে, এটি উল্লিখিত বিষয়ে একটি চমৎকার কিতাব।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।