ত্রিবেণি # আল মাহমুদ আল মাহমুদের ছোট ছোট তিনটি উপন্যাস- ‘পুরুষ সুন্দর’ ‘নিশিন্দা নারী’ ও ‘গুহা মানব’ নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। আছে প্রবল নিন্দা। অনেকে মনে করেন এগুলো অশ্লীল- এমনটা না লিখলেও পারতেন তিনি। অবশ্য এর বিচার এখন সময়ের কাছে। মানুষ-জীবন-প্রত্যাশা-প্রাপ্তি-আকাঙ্ক্ষা আল মাহমুদের গল্পের মূল ক্যানভাস। নারী- তার রূপের বর্ণনা, প্রকৃতির সাথে নারীর তুলনা, পরিবার ও সমাজে নারীর অবস্থান এবং নিয়তির অমোঘতা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। আল মাহমুদের কথাসাহিত্যে কাব্যিক আবহ আছে; রয়েছে সৌন্দর্য আর প্রকৃতিনিবিড়তার ঘনিষ্ট ছবি। সমাজ- তার সমূহ উত্থান-পতন, মানুষের স্বপ্ন-আশাভঙ্গ আর প্রত্যাশার জাল তিনি তৈরি করেন দারুণ মমতায়। বর্ণনাকৌশলে তাঁর কাহিনি-কাঠামো পরিবার-কাঠামোরই এক একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায় যেন। প্রখ্যাত কথাশিল্পী আবু রুশদ মন্তব্য করেছেন- ‘বাংলাদেশে আল মাহমুদের সমতুল্য অন্য কোন কবির হাত থেকে এত কয়টা ভাল গল্প বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্বে ঈর্ষণীয় মাত্রা যোগ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’ আল মাহমুদের তিনটি উপন্যাস একত্রে ত্রিবেণি নামে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।