মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের স্বরতন্ত্রী এমনভাবে গঠিত, যা দিয়ে প্রায় সবরকম ধ্বনি উচ্চারণ করা যায়। স্বরকম্পনের তারতম্যে স্বরের উঠানামা দিয়ে স্বাভাবিক, উচ্চ এবং নিম্ন স্কেলে শব্দ সৃজন করা যায়। অনেক শ্রুতিনন্দন সুর সৃষ্টি করা যায়। সুর সঙ্গীতের প্রধান উপাদান। সুর মনকে আন্দোলিত করে। মনে নানারকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। সঙ্গীত সাধনা হলাে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলাের মধ্যে অন্যতম। দেশাত্মবােধক গান বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারের অনুপম রত্মরাজি। বাংলা গানের জগতে দেশাত্মবােধক গানের স্থান চির উচ্চ এবং অটুট। আমাদের দেশাত্মবােধক সঙ্গীত দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান মুক্তিযােদ্ধাসহ প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষকে যেমন উদ্দীপ্ত করেছিল, প্রেরণা জুগিয়েছিল, একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী নৃশংস সৈন্যদের এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের একটু একটু করে মনােবল ভেঙে দিয়েছিল। লক্ষণীয় যে, দেশাত্মবােধক গান অন্য গানগুলাে থেকে আলাদা। এই ধরণের গানের প্রতিটি শব্দে আছে ভাব, আবেগ, প্রৈতিপ্রেরণা। আছে মা-মাটি-মানুষের প্রতি টান, গভীর অনুভূতি। শিল্পীর নিজস্ব পারঙ্গমে, গায়কীতে এবং গায়নশৈলীতে দেশের গানগুলাে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ হয়। প্রতিটি গান যেন শিল্পীর ভক্তি নম্র শুচিতায় সমৃদ্ধ, আপন দীপ্তিতে ভাস্বর ও বৈচিত্রপূর্ণ। সার্বিকভাবে দেশাত্মবােধক গানের স্বতন্ত্র ঐশ্বর্য এবং সুরের লালিত্য শ্রোতার মন আকৃষ্ট করে, আবিষ্ট করে। প্রতিটি গান যেন সমহিমায় সমুজ্জ্বল। নবীন প্রবীণ সকল প্রজন্মের ভালােলাগার মতাে একশ’ একটি দেশাত্মবােধক গান নিয়ে এই স্বরলিপি বইটি রচিত হয়েছে। এই শ্রেণীর গানের আবেদন সর্বজনীন এই কথা ভেবেই এই বৃহৎ স্বরলিপি সঙ্কলনটি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছি। এক্ষেত্রে যাদের সাহায্য ও প্রেরণা পেয়েছি, যাদের অবদানে স্বরলিপিগুলাে মলাটে বন্দী হয়ে গ্রন্থ হিসেবে আলাের মুখ দেখছে, সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে যেতে পারছে, তারা হলেন দিলীপ গুহঠাকুরতা, শামীমা রহমান মুন্নী, নাসরিন বেগম ও সৈয়দ আরমান রেজা। একই সাথে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই মােঃ শরিফুল ইসলামকে। যিনি অত্যন্ত আন্তরিকতায় এবং গভীর মনােযােগে প্রতিটি স্বরলিপি যতটা সম্ভব নির্ভুলভাবে কম্পােজ করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। দেশকে আমি সর্বদা মনের উচ্চতম আসনে বসিয়েছি। স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছরে সব রকম পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মনে সবসময় অকুতােভয়ে ধারণ করেছি, জাগরূক রেখেছি। সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে কোনদিন বিচ্যুত হইনি। দেশাত্মবােধক গানের প্রতি আমার তাই একটি আলাদা টান। মাতৃভূমির প্রতি সেই টান ও আবেগের তাগিদেই অনেক শ্রুত। গানের সাথে সাথে বর্তমানে স্বল্পগীত গানগুলােকে বিস্মরণের সলিলে অবগাহনের আগে যেন ধরে রাখা যায়, সেই মানস থেকেই একশ’একটি দেশাত্মবােধক গান নির্বাচন করে স্বরলিপি করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার অনেক মহান এবং বিদগ্ধ মনিষী বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতিতে এই গানগুলাে রচনা করেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি গানের বাণী ও মূল সুরকে অবিকৃত রেখে কণ্ঠে বা যন্ত্রে তােলার মতাে করে আমি স্বরলিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। গানগুলাে যাদের কণ্ঠে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় হয়েছে, তাদের মত করে নিখুঁতভাবে সুরসমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব প্রতিটি গানের মুল সুরের একদম নৈকট্যে গিয়ে শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়ন করতে। তবুও যারা এই গ্রন্থের স্বরলিপি অনুসরণ করে দেশাত্মবােধক গান গাইবেন বা যন্ত্রে তুলবেন, আমার বিশ্বাস তাঁরা গানের বৈশিষ্ট্য, মেজাজ, ঢং এবং গায়কী সম্পর্কে সজাগ থাকবেন। এই গ্রন্থের কোন স্বরলিপি থেকে একজন সঙ্গীত শিক্ষানবিশও সামান্য উপকৃত হয়েছেন শুনলে আমার কষ্ট বৃথা যায়নি ভাববাে।