ভূমিকা বিবেকানন্দ রচনাবলীর দ্বিতীয় ও শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হলো। আমাদের প্রথম খণ্ডটি পাঠকসমাজে বিশেষ সমাদর লাভ করার জন্য আমরা খুশী। আমাদের খণ্ড দুটি আকারে সুবৃহৎ হলেও ‘সমগ্র বিবেকানন্দ রচনাবলী' এই নামকরণে হয়ত অনেকে বিস্ময়বোধ করেছেন। কিন্তু এখানে আমাদের বক্তব্য এই যে, এক্ষেত্রে 'সমগ্র' কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, ভাবগত অর্থে যাথার্থ্য লাভ করেছে। এখানে সমগ্রতা অর্থে এই কথাই বোঝান হয়েছে যে ঊনবিংশ শতকের সারা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী স্বামী বিবেকানন্দের বহুমুখী আদর্শ ও চিন্তাধারার যতগুলি দিক বা বিষয় আছে, সেই সব বিষয়গুলি প্রতিনিধিত্বমূলক সব রচনাই এই দুটি খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বামীজীর অজস্র রচনায় যে আদর্শের বাণী বারবার ধ্বনিত হয়েছে, যে বাণী সমস্ত ভূমিখণ্ড ও কালখণ্ড অতিক্রম করে সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে এবং আজও যে বাণী বিশ্বমানবের মুক্তির একমাত্র পথ, অমৃতনিষ্যন্দি সে অভয় বাণী হলো এই যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোন মানুষই ক্ষুদ্র বা দুর্বল নয় ; মানুষকে ঈশ্বরের পিছনে ছুটে চলতে হবে না অসহায়ভাবে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আগে হতেই আছে ঐশ্বরিকতা আর পূর্ণতা। শুধু তার আত্মাকে জাগাতে হবে। মানুষের আত্মা জাগ্রত হলেই সেই জাগ্রত আত্মার মধ্যে তার পূর্ণতাকে খুঁজে পাবে। তখন সে স্থান, কাল ও কার্যকারণের নিয়মশৃঙ্খল ও প্রকৃতির বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে হয়ে উঠবে অনন্ত, ‘ছোট আমি' ত্যাগ করে সে হয়ে উঠবে ‘বড় আমি’ বা বৈশ্বিক মানুষ। হয়ে উঠবে সোহং মন্ত্রে চৈতন্যসিদ্ধ। স্বামীজী বলেছেন, একজন মানুষ সমুদ্রের এক বিন্দু জলের মত ক্ষুদ্র এবং আর একজন মানুষ সমুদ্রতরঙ্গের মতই উন্নত হতে পারে। কিন্তু উভয়ের মধ্যেই আছে সেই এক সমুদ্রের অনন্তত্ব। তিনি বলতেন, সমাজসংস্কারের প্রকৃত অর্থ হলো মানুষকে আত্মশক্তি দান করা যে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে মানুষ তার জীবনের যত সব সমস্যার নিজেই সমাধান করবে। স্বামীজী বলেছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোন বিরাগ বা বিতৃষ্ণা থাকবে না। সবাই আপন আপন পথে চলবে তবে ভারতকে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে বিজ্ঞান ও কারিগরীবিদ্যার অনেক কিছু শিখতে হবে এবং ভারত পাশ্চাত্যকে দান করবে তার অনন্তকালের ঐতিহ্যমণ্ডিত আধ্যাত্মিক জ্ঞান। ধর্ম সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, বিশ্বের প্রতিটি মানুষ স্বধর্মনিষ্ঠ হয়েও বিশ্বের অন্য সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। প্রতিটি ধর্মের মূল সত্য এক—ধর্মপ্রচারকদের এই শিক্ষা দান করতে হবে মানুষকে। তিনি চেয়েছিলেন ভারতে শুধু ধর্মপ্রচার করলে হবে না, ধর্মের কথা অনেক বলা হয়েছে, ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাদান করতে হবে এবং তার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত মঠের উৎসর্গীকৃতপ্রাণ যুবক সন্ন্যাসীরা গ্রামে গ্রামে দরিদ্র নিরক্ষর ও মানুষদের শিক্ষা দান করবে।
এই সব আদর্শসম্বলিত সব রচনাই সন্নিবেশিত হয়েছে আমাদের দুটি খণ্ডে। দ্বিতীয় খণ্ডটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো স্বামীজীর দিব্যবাণী সংকলন এবং বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর এবং বাংলায় এসে Alice নাম পেয়েছে— অমলা। এমনি একটু-আধটু অদল- বদল ছাড়া ইংরেজির মূল রস বজায় আছে বলেই মনে করি। তবে এটুকুও এখানে বলে রাখা উচিত মনে করছি যে, Alice in Wonderland-এর যে সংস্করণ দেখে এই বাংলা বইখানি লেখা হয়েছে, সেখানিও সম্পূর্ণ সংস্করণ নয় ।